উদ্ধৃত বিবরণ হইতে বেশ বুঝা যাইতেছে যে, মহাভারতের উক্ত অংশ রচনাকালে বর্ত্তমান বাঙ্গালা প্রেসিডেন্সি মগধ (বর্ত্তমান বেহার), কর্ণের রাজ্য অঙ্গ (বর্ত্তমান ভাগলপুর জেলা), মোদাগিরি (বর্ত্তমান মুঙ্গের), পুণ্ড্র (বর্তমান মালদহ হইতে বগুড়া পর্য্যন্ত), কৌশিকীকচ্ছ (বর্ত্তমান হুগলী জেলা), বঙ্গ (বর্ত্তমান ভাগীরথীর পূর্ব্বাংশ), সুহ্ম[১] (রাঢ়), প্রসুহ্ম, তাম্রলিপ্ত (বর্ত্তমান তমলুক জেলা), কর্ব্বট ইত্যাদি বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত ও তত্তৎপ্রদেশ বিভিন্ন রাজার অধিকারে বিন্যস্ত ছিল। নিম্নবঙ্গের অধিকাংশ সে সময়ে সমুদ্রগর্ভশায়ী ছিল। নদীয়া, যশোর, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, চব্বিশ পরগণা ও মুর্শিদাবাদ জেলার কিয়দংশ বা বগড়ী বিভাগের তৎকালে অস্তিত্ব ছিল না।
যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের পর পুণ্ড্রাধিপ বাসুদেব অতিশয় প্রবল হইয়া উঠিয়াছিলেন। হরিবংশ ও নানা পুরাণ আলোচনা করিলে মনে হইবে যে, ক্ষত্রিয় বীর পৌণ্ড্রক বাসুদেব বর্তমান বাঙ্গালা প্রেসিডেন্সীর অধিকাংশ স্থান জয় করিয়া একজন অতি প্রতাপশালী রাজাধিরাজ হইয়া উঠিয়াছিলেন। বহু নরপতি তাঁহার অধীনতা স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। নিষাদপতি অদ্বিতীয় বীর একলব্য, মগধপতি জরাসন্ধ এবং প্রাগ্জ্যোতিষপতি ভগদত্তের পিতা নরক তাঁহার বন্ধু ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ নরককে নিধন করিলে পৌণ্ড্রক বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত হইয়াছিলেন। তাঁহার রাজ্য
——
- ↑ সুহ্মকে কেহ কেহ মেদিনীপুর জেলা বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। কিন্তু মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠের মতে “সুহ্মাঃ রাঢ়াঃ।”
দণ্ডঞ্চ দণ্ডধারঞ্চ বিজিত্য পৃথিবীপতীন্।
তৈরেব সহিতঃ সর্ব্বৈর্গিরিব্রজমুপাদ্রবৎ॥ ১৭
জারাসন্ধিং সান্ত্বয়িত্বা করে চ বিনিবেশ্য হ।
তৈরেব সহিতঃ সর্ব্বৈঃ কর্ণমভ্যদ্রবদ্বলী॥ ১৮
স কম্পয়ন্নিব মহীং বলেন চতুরঙ্গিণা।
যুযুধে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠঃ বর্ণেনামিত্রঘাতিনা॥ ১৯
স কর্ণং যুধি নির্জ্জিত্য বশে কৃত্বা চ ভারত।
ততো বিজিগ্যে বলবান্ রাজ্ঞঃ পর্ব্বতবাসিনঃ॥ ২০
অথ মোদাগিরৌ চৈব রাজানং বলবত্তরম্।
পাণ্ডবো বাহুবীর্য্যেণ নিজঘান মহামৃধে॥ २১
ততঃ পুণ্ড্রাধিপং বীরং বাসুদেবং মহাবলম্।
কৌশিকীকচ্ছনিলয়ং রাজানঞ্চ মহৌজসম্॥ ২২
উভৌ বলভৃতৌ বীরাবুভৌ তীব্রপরাক্রমৌ।
নিৰ্জ্জিত্যাজৌ মহারাজ বঙ্গরাজমুপাদ্রবৎ॥ ২৩
সমুদ্রসেনং নিৰ্জ্জিত্য চন্দ্রসেনঞ্চ পার্থিবম্।
তাম্রলিপ্তঞ্চ রাজানং কর্ব্বটাধিপতিং তথা॥ ২৪
সুহ্মানামধিপঞ্চৈব যে চ সাগরবাসিনঃ।
সর্ব্বান্ ম্লেচ্ছগণাংশ্চৈ বিজিগ্যে ভরতর্ষভঃ॥ ২৪ (সভাপর্ব্ব ৩০ অঃ)
উদ্ধৃত বিবরণ হইতে মনে হইবে যে পৌণ্ড্রক বাসুদেব আপনাকে প্রকৃত অবতার করিতে যত্নবান্ হইয়াছিলেন, অথবা তাঁহার অধিকারভুক্ত বাঙ্গালী সামস্ত ও প্রজাগণ তাঁহাকে ভগবান্ বাসুদেব কৃষ্ণ হইতে শ্রেষ্ঠ মনে করিয়াছিল। আশ্চর্য্যের বিষয়, পুণ্ড্রাধিপ কৃষ্ণদ্বেষী হইলেও একজন অসাধারণ বীর, ও ক্ষত্রিয়কুলগৌরব বলিয়া বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশে কীর্ত্তিত। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তাঁহার অভূতপূর্ব্ব বীর্য্যদর্শনে বিস্ময়বিমুগ্ধ হইয়াছিলেন। আমরা হরিবংশ ও পুরাণ হইতে আরও জানিতে পারি যে, যখন নরকহন্তা শ্রীকৃষ্ণের দিগন্তবিস্ফারিত যশোগাথা পুণ্ড্রাধিপতির কর্ণগোচর হইল, তখন এই বঙ্গবীর আর কিছুতেই স্থির থাকিতে পারিলেন না। তিনি অষ্ট সহস্র রথ, অযুত হস্তী ও প্রায় অর্ব্বুদ পত্তি লইয়া শ্রীকৃষ্ণের ধ্বংসোদ্দেশে দ্বারকায় যাত্রা করিলেন। ভারতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্তে গিয়া বাঙ্গালী বীরগণ যে অদ্ভুত বীরত্বের পরিচয় দিয়া গিয়াছেন, তাহা কৃষ্ণভক্ত পুরাণকারের লেখনীতেও সুস্পষ্ট প্রতিভাত হইয়াছে। বলিতে কি, বঙ্গাধিপের অসাধাবণ শরপ্রহারে শত শত যাদববীর ধরাশায়ী হইয়াছিল। সেই ভীষণ যুদ্ধে পৌণ্ড্রকের অস্ত্রে নিশঠ, সারণ, কৃতবর্ম্মা, উগ্রসেন, উদ্ধব, অক্রূর, সাত্যকি প্রভৃতি মহারথীগণ আহত হইয়াছিলেন। বঙ্গবীরকে পরাজয় করিতে কোন যাদববীর সমর্থ হন নাই। অবশেষে যখন সাত্যকীর সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করিয়া বঙ্গবীর নিতান্ত পরিশ্রান্ত, সেই সময় ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ রণক্ষেত্রে উপস্থিত হইলেন। পুণ্ড্রাধিপ সম্মুখে আততায়ীকে দেখিয়া সত্যিকীকে পরিত্যাগ করিয়া শ্রীকৃষ্ণকে আক্রমণ করিলেন। দেবকীনন্দন পুণ্ড্রাধিপের শক্তি নিরীক্ষণ করিয়া ——
- ↑ হরিবংশ ভবিষ্যপ৹ ১৯ অঃ।