পাতা:বিশ্বকোষ ঊনবিংশ খণ্ড.djvu/৪০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বঙ্গদেশ (জৈন ও বৌদ্ধপ্রভাব)
[৪০৬]
বঙ্গদেশ (জৈন ও বৌদ্ধপ্রভাব)

বৌদ্ধ ও জৈনগ্রন্থ আলোচনা করিয়া সুপ্রসিদ্ধ পাশ্চাত্যপণ্ডিত জেকোবি লিথিয়াছেন, ‘জৈন ও বৌদ্ধদিগের তিক্ষু বা শ্রমণধর্ম্ম ব্রাহ্মণধর্ম্মগ্রন্থ হইতে গৃহীত হইলেও তাহা প্রধানতঃ ও মূলতঃ ক্ষত্রিয়দিগের জন্যই বিহিত হইয়াছিল।’[]


বঙ্গে জৈন ও বৌদ্ধপ্রভাব।

 আমরা মহাভারত, হরিবংশ ও নানাপুরাণ আলোচনা করিয়া পাইয়াছি যে মগধ, অঙ্গ, বঙ্গ, ও সুহ্মের ক্ষত্রিয় বীরগণ পরস্পর আত্মীয়তা ও মিত্রতা পাশে আবদ্ধ ছিলেন; তাঁহাদের আচার ব্যবহার অনেকটা এক ছিল। তাহার কারণ এই, এখানকার ক্ষত্রিয়বংশে যখনই কোন মহাপুরুষ আবির্ভূত হইয়াছেন, তিনিই সাধারণকে উচ্চ জ্ঞানোপদেশ প্রদান করিয়া উন্নত ও একভাবাপন্ন করিতে চেষ্টা পাইয়াছেন। পরবর্ত্তী ব্রাহ্মণগ্রন্থ এ সম্বন্ধে অনেকটা নিস্তব্ধ থাকিলেও প্রাচীন জৈন ও বৌদ্ধগ্রন্থসমূহ হইতে তাহার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। আদি ব্রাহ্মণশাস্ত্রসমূহ যেরূপ গুরুপরম্পরায় মুখে মুখে চলিয়া আসিয়াছে, আদি জৈন ও বৌদ্ধগ্রন্থসমূহও সেইরূপ গুরুপরম্পরায় মুখে মুখে চলিয়া আসিয়া ব্রাহ্মণশাস্ত্রসমূহের ন্যায় পরে লিপিবদ্ধ হইয়াছে। ঐ সকল পরম্পরাগত জৈন গ্রন্থ হইতে আমরা দেখিতে পাই যে জিনধর্ম্মপ্রচারক ২৪ জন তীর্থঙ্করের মধ্যে কেবল আদি জিন ঋষভ দেব ব্যতীত ২ অজিতনাথ, ৩ সম্ভবনাথ, ৪ অভিনন্দন, ৫ সুমতিনাথ, ৬ পদ্মপ্রভ, ৭ সুপার্শ্ব, ৮ চন্দ্রপ্রভ, ৯ সুবিধিনাথ, ১০ শীতলনাথ, ১১ শ্রেয়াংসনাথ, ১২ বাসুপূজ্য, ১৩ বিমলনাথ, ১৪ অনন্তনাথ, ১৫ ধর্ম্মনাথ, ১৬ শান্তিনাথ, ১৭ কুন্থুনাথ, ১৮ অরনাথ, ১৯ মল্লিনাথ, ২০ মুনিসুব্রত, ২১ নমীনাথ, ২২ নেমিনাথ, ২৩ পার্শ্বনাথ ও ২৪ মহাবীর এই ২৩ জন তীর্থঙ্করের সহিত বাঙ্গালীর সংস্রব ঘটিয়াছিল। ইঁহারা সকলেই পরম জ্ঞানী বলিয়া জৈন সমাজে ‘দেবাধিদেব’ অর্থাৎ দেবব্রাহ্মণ হইতে শ্রেষ্ঠ বলিয়া পূজিত।[]

 উক্ত তীর্থঙ্করগণের মধ্যে ২৩শ তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ ৭৭৭ খৃষ্টপূর্ব্বাব্দে বাঙ্গালার মানভূম জেলাস্থ সমেতশিখরে (বর্ত্তমান পরেশনাথ পাহাড়ে) মোক্ষলাভ করেন। ২৭০০ বর্ষ পূর্ব্বে ——

  1. “It may be remarked that the monastical order of the Jainas and Buddhist though copied from the Brahmans were chiefly and originally intended for Kshatriyas”—Sacred Books of the East, Vol. xxii. p. xxxff
  2. অঙ্গরাজবংশে বিজয় প্রভৃতি দুই একজন রাজকুমার ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় হইতে শ্রেষ্ঠ এবং দেবগণেরও পূজিত বলিয়া কীর্ত্তিত হইয়ছেন। এ কথা আমাদের হরিবংশ হইতেও পাওয়া যায়।
রাঢ়বঙ্গে তাঁহার প্রভাবে অনেকেই তৎপ্রচারিত চাতুর্যামধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন।[] অরিষ্টনেমিপুরাণান্তর্গত জৈন হরিবংশে লিখিত আছে, যাদবপতি শ্রীকৃষ্ণের জ্ঞাতি নেমিনাথ অঙ্গবঙ্গাদি দেশে আসিয়া জৈন ধর্ম্ম প্রচার করিয়াছিলেন।[] যে সময়ে ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মণ্যধর্ম্মরক্ষায় সাত্ত্বত ধর্ম্ম প্রচারে নিরত, সেই সময়ে তাঁহারই এক জ্ঞাতি ক্ষাত্র ভিক্ষুধর্ম্ম প্রচারে অগ্রসর হইয়াছিলেন। তাঁহার মত ব্রাহ্মণবিরোধী ছিল বলিয়া ব্রাহ্মণদিগের ধর্ম্মগ্রন্থে স্থানলাভ করে নাই বটে, কিন্তু জৈনাচার্য্যগণ তাহা রক্ষা করিয়া আর্য্যসমাজের আর এক দিক্‌কার চিত্র দেখিবার অবসর দিয়া গিয়াছেন। যদিও তৎকালে জিনধর্ম্ম আর্য্যসমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল কি না সন্দেহ, কিন্তু তখনও ৰে পূর্ব্ব ভারতের এক প্রান্তে ক্ষত্রিয়-সন্তান স্ব স্ব প্রাধান্য রক্ষায় উদ্‌যুক্ত ছিলেন, তাহ হিন্দু ও জৈন উভয়ের হরিবংশে অল্পবিস্তর চিত্রিত হইয়াছে। ইহাও অসম্ভব নহে যে, নেমিনাথের ন্যায় ক্ষত্রিয়প্রচারকদিগের উত্তেজনায় পৌণ্ড্রক বাসুদেব কৃষ্ণদ্বেষী হইয়া পড়িয়াছিলেন। যাহা হউক, সেই অতীত যুগের তিমিরাবৃত ইতিবৃত্ত তর্কসঙ্কুল বলিয়া ও নিঃসন্দেহ ভ্রমপ্রমাদপরিশূন্য হইবার সম্ভাবনা না থাকায় এখানেই ক্ষাত্ত হইলাম।

 মহাভারতকার “বীর্য্যশ্রেষ্ঠাশ্চ রাজানঃ”[] বলিয়া ক্ষত্রিয়ের শ্রেষ্ঠতা ঘোষণা করিয়া গিয়াছেন। কুরুক্ষেত্রের কুলক্ষয়কর মহাসমর হইতেই আর্য্যাবর্ত্তের ক্ষত্রিয়প্রভাব খর্ব্ব হইতে থাকে এবং সীমান্ত প্রদেশ হইতে অপর দুৰ্দ্ধৰ্ষ জাতিগণ ভারতপ্রবেশের সুবিধা পায়। ব্রাহ্মণপ্রাধান্যও বাড়িয়া উঠে। ঐ সময়ে পূর্ব্ব ও দক্ষিণ-ভারতে ব্রাহ্মণগণ কর্ম্মকাণ্ড প্রচারের সহিত পৌরাণিক দেবপূজাপ্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হইয়াছিলেন এবং ক্ষত্রিয়েতর জনসাধারণ অনেকেই আদরের সহিত কর্ম্মকাণ্ডবহুল সহজ পূজায় অনুরক্ত হইতেছিল। কিন্তু সে সময় উত্তরপশ্চিম ভারতে ক্ষত্রিয় প্রভাব হ্রাস হইলেও পূর্ব ভারতে এক কালে হ্রাস হইতে পারে নাই। বরং এখানকার ক্ষত্রিয়গণের অভ্যুদয়ের সুবিধা হইয়াছিল। তাঁহারা কর্ম্মকাণ্ডবহুল দেবপূজায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। আত্মসংযম ও আত্মোৎকর্ষ-লাভে সকলেই সচেষ্ট ছিলেন। কুরুক্ষেত্রে ক্ষাত্রজীবনের ভীষণ পরিণাম দেখিয়া তাঁহারা অসিচালনা অপেক্ষা মোক্ষপথের উপায় বাহির করাই পুরুষার্থ মনে করিয়াছিলেন। তাহারই ফলে পূর্ব্বভারতে বুদ্ধ ও তীর্থঙ্করগণের অভ্যুদয় ঘটিয়াছিল।

——

  1. জৈন শব্দ এবং ভগবতী সূত্রে বিস্তৃত বিবরণ দ্রষ্টব্য।
  2. জৈন হরিবংশে ৬১ ও ৬২ সর্গ।
  3. মহাভারত আদিপর্ব্ব ১৩০।১৯।