পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী (৬।২।১০০) ও জৈন হরিবংশ পাঠে জানিতে পারি ষে ভারতীয় যুগের পর পূর্ব্বভারতে “অরিষ্টপুর” ও “গৌড়পুর” নামে দুইটী প্রধান নগর ছিল। জৈন হরিবংশে অরিষ্টপুর ও সিংহপুরের একত্র উল্লেখ পাওয়া যায়। অরিষ্টনেমি বা নেমিনাথের নাম হইতে অরিষ্টপুরের নামকরণ হওয়াও কিছু অসম্ভব নহে। ঐ তিনটী প্রাচীন নগরীর মধ্যে গৌড়পুর পুণ্ড্রদেশে ও অরিষ্টপুর উত্তর রাঢ়ে ছিল বলিয়া মনে হয়। গৌড়পুর হইতেই পরে গৌড়রাজ্যের নামকরণ। প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থোক্ত সিংহপুর নামক প্রধান নগর সুহ্ম বা রাঢ়দেশে অবস্থিত ছিল। এইরূপে সমস্ত রাঢ়দেশও পূর্ব্বকালে এক সময় সিংহপুর রাজ্য বলিয়া গণ্য হইয়াছিল। এখন “সিংহভূম” প্রাচীন সিংহপুরের স্মৃতি জাগাইয়া রাখিয়াছে।
জৈনদিগের অঙ্গ ও কল্পসূত্র অনুসারে বলিতে য়হ যে, খৃষ্টজন্মের প্রায় ৮০০ বর্ষ পূর্ব্বে ২৩শ তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ স্বামী কর্ম্মকাণ্ডের প্রতিকূলে পুণ্ড্র, রাঢ় ও তাম্রলিপ্ত প্রদেশে চাতুর্ধাম ধর্ম্ম প্রচার করেন। তৎপরে অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধের রাজভবনে অগ্নিহোত্রশালা প্রতিষ্ঠিত থাকিলেও ধার্ম্মিক ও জ্ঞানিগণ ঔপনিষদীয় অন্তর্যজ্ঞের অনুষ্ঠানে তৎপর ছিলেন।
পার্শ্বনাথ স্বামী বৈদিক পঞ্চাগ্নিসাধনাদির প্রতিকূলে স্বীয় মত প্রচার করিলেও জৈনদিগের সুপ্রাচীন অঙ্গ ভগবতীসূত্র হইতে জানিতে পারি যে, শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীর চতুর্ব্বেদাদি অবহেলা করেন নাই, তাঁহার পূর্ব্বপুরুষগণ পার্শ্ব উপাসক ও শ্রমণের শিষ্য। তিনি জ্ঞানকাণ্ডেরই সমর্থন করিয়া গিয়াছেন।[১] এক সময়েই মহাবীর ও শাক্যবুদ্ধের অভ্যুদয়, উভয়েই ব্রাহ্মণ অপেক্ষা ক্ষত্রিয়ের শ্রেষ্ঠতা প্রচার করিয়া গিয়াছেন।[২] উভয়েই আত্মীয়তাসূত্রে আবদ্ধ ছিলেন। উভয়েই বৈদিক কর্ম্মকাণ্ডের নিন্দা এবং জ্ঞানকাণ্ডের আবশ্যকতা ঘোষণা করিয়া গিয়াছেন। তাঁহাদের জন্মকালে অঙ্গদেশে ব্রহ্মদত্ত এবং মগধে শ্রেণিক বিম্বিসারের পিতা ভট্টিয় রাজত্ব করিতেছিলেন। ব্রহ্মদত্ত ভট্টিয়কে যুদ্ধে পরাজয় কবেন। তাহার প্রতিশোধ লইবার জন্য বিম্বিসার অঙ্গরাজ্য অধিকার করেন। পিতার মৃত্যুকাল পর্য্যন্ত তিনি অঙ্গের রাজধানী চম্পা পুরীতেই অবস্থান করিয়াছিলেন। তৎপরে তিনি রাজগৃহে আসিয়া পিতৃসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হইয়াছিলেন।
শ্রেণিক বিম্বিসার যে সময় চম্পায় অধিষ্ঠিত, সেই সময় বুদ্ধদেব ——
মহাবগ্গে বর্ণিত হইয়াছে যে, উহারই কিছুপূর্ব্বে জটিল উরুবিল্ব কাশ্যপ এক মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, তাঁহার যজ্ঞসভায় অঙ্গ ও মগধের বহু লোক উপস্থিত হইয়াছিল।[২] উক্ত প্রমাণ হইতে মনে হয় যে, তখনও পূর্ব্বভারতে যাগযজ্ঞের আদর ছিল, বহুদূর হইতে জনসাধারণ যজ্ঞ দেখিতে আসিত।
বৈদিক সময়ে স্ত্রীশিক্ষার যথেষ্ট আদর ছিল। আত্রেয়ী, গার্গী প্রভৃতি ঋষি-রমণীগণ শিক্ষিত আর্য্যমহিলার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত! কিন্তু কিছুকাল পরে স্ত্রীগণের পক্ষে বেদপাঠ ও সন্ন্যাসাশ্রম নিষিদ্ধ হয়। খৃষ্টপূর্ব্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দে মহাবীর ও বুদ্ধদেব রমণীগণকে সমান অধিকার প্রদান করিয়াছিলেন।[৩] সাধারণের বিশ্বাস যে, মহাবীর ও বুদ্ধদেব দ্বিজ ও শূদ্রকে সমান অধিকার প্রদান করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহা ঠিক নয়। তখনও কেহ দ্বিজ ও শূদ্রের মধ্যে বর্ণধর্ম্মের কঠোরতা শিথিল করিতে সমর্থ হন নাই। দুই একজন সাধুর কথা বলিতেছি না, মহাবীর ও বুদ্ধ উভয়েই সাধারণ শূদ্রজাতিকে উচ্চ জ্ঞানমার্গের অনধিকারী বলিয়াই স্থির করিয়াছেন।[৪]
রাজগৃহপতি বিম্বিসার (শ্রেণিক) মহাবীর ও বুদ্ধ উভয়েরই ধর্ম্মোপদেশ আগ্রহ সহকারে শ্রবণ করিতেন। এই কারণেই বোধ হয়, জৈন ও বৌদ্ধগ্রন্থে যথাক্রমে তিনি জৈন ও বৌদ্ধ নরপতি বলিয়া খ্যাত হইয়াছেন। তৎপুত্র অজাতশত্রু, জৈন গ্রন্থে ইনি কুণিক নামে খ্যাত। অজাতশত্রু রাজগৃহ ছাড়িয়া চম্পায় আসিয়া রাজধানী করেন।[৫] এই সময় হইতে কিছুকাল চম্পা নগরী (ভাগলপুরের নিকটবর্ত্তী চম্পাই নগর) ভারতসাম্রাজ্যের রাজধানী বলিয়া খ্যাত হইয়াছিল। অজাতশত্রুর সময়ে গণধর সুধর্ম্ম স্বামী জম্বুস্বামীর সহিত চম্পায় আসিয়া জৈনধর্ম্ম প্রচার করেন।[৬] কিন্তু তৎকালে বেশী লোক বুদ্ধমতেরই অনুরক্ত ছিল। কিছুকাল পরে জম্বুস্বামীর শিষ্য বৎসগোত্রসম্ভূত শয্যম্ভব আসিয়া চম্পায় জৈনধর্ম্ম প্রচার করেন, তাহাতে বহু লোক জৈনধর্ম্মে দীক্ষিত ——
- ↑ মহাবগ্গ ৯ম স্কন্ধ ১।
- ↑ মহাবগ্গ ১।১৯।১-২।
- ↑ বিনয়পিটকের চুল্লবগ্গে বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদিগের অধিকার ও কার্য্য-প্রণালী বর্ণিত হইয়াছে।
- ↑ মহাবগ্গ হইতে জানা যায় যে বুদ্ধ নির্দ্দেশ করিতেছেন, ‘কোন দাস (শূদ্র) প্রব্রজ্যা লইবে না। যে তাহাকে প্রব্রজ্যা উপদেশ দিবে, সে দুষ্কট পাপে লিপ্ত হইবে।” (মহাবগ্গ ১।৪৭)
- ↑ হেমচন্দ্রের পরিশিষ্ট পর্ব্ব ৬।৩২।
- ↑ হেমচন্দ্রের পরিশিষ্ট পর্ব্ব ৪।৯।