বলরামী তদীয় পুত্র এবং রামদেব ও রামরাম রায়ের পুত্ৰগণ একত্র ছিলেন, পরে পৃথক্ হইয়াছিলেন। বলরামের বংশ বড় তরফ, বামদেৰের বংশ মধ্যম তরফ ও রামরাম রায়ের বংশ ছোট তরফ নামে পরিচিত । রামরাম রায়ের উদারতা ও তীক্ষ বুদ্ধি সম্বন্ধে বিবিধ প্রবাদ প্রচলিত আছে। তাহার লোক জন ভাল আহার করিত, কিন্তু নিজে কখনও ভাল আহারের জন্য লোলুপ ছিলেন না। তিনি যে সময় রাজা রামজীবনের দেওয়ান, তৎকালে তাহার স্বগ্রামবাসী এক ব্যক্তি মুন্সী ছিলেন। তিনি রামরাম রায়কে অপদস্থ করিবার জন্ত অনেক কাগজের মধ্যে একখানি তালুক দানপত্র সহি করিয়া লয়েন। তিনি “বরাত আশমান” কথা লিখিয়া দেন। রাজা রামজীবন মুনসীর নিকট দেওয়ানের দানের কথা শুনিয়া তৎপ্রতি ক্রুদ্ধ হয়েন ; কিন্তু পরে প্রকৃত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিয়া সন্তোষ লাভ করেন । রামরাম নাটোর জমিদারীর সৃষ্টি হইতে রাজা রামজীবনের পরলোকগমনের পরও অত্যর কাল দেওয়ানী করেন। রাজা ৰামকান্ত যৌবনের প্রারম্ভে প্রাচীনদিগের সৎপরামর্শ অবহেলা কবায় ও রামরায়ের বাৰ্দ্ধক্যবশতঃ সেই বর্ষে তিনি কৰ্ম্ম পবিত্যাগ করেন । বলরামী, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভেদ। বলরাম হাড়ি এই সম্প্রদায়ের প্ৰবৰ্ত্তক, এই নিমিত্ত ইহা বলরামী নামে কথিত। নদীয়া জেলার অন্তর্গত মেহেরপুর গ্রামের মালো-পাড়ায় তাহার জন্ম হয়। তাহার পিতার নাম গোবিন্দ হাড়ি ও মাতার নাম গৌরমণি । ১২৫৭ সালের ৩০এ অগ্রহায়ণ অনুমান ৬৫ পয়ষট্টি বৎসর বয়ঃক্রমে তাহার মৃত্যু হয় । বলরাম ঐ গ্রামের মল্লিক বাবুদিগের বাটতে চৌকিদারি কৰ্ম্ম করিত। তাহদের ভবনে আনন্দবিহারী নামে এক ধগ্রহ আছে, একদা ঐ বিগ্রহের স্বর্ণালঙ্কার চুরি যাওয়াতে, বাবুর বলবামকে কিছু শাসন করেন। তাহাতে সে বাটা পরিত্যাগ করিয়া গেরুয়া বস্ত্র পরিধানপূৰ্ব্বক, উদাসীন হইয়া যায় এবং এই স্বনাম-প্রসিদ্ধ উপাসক-সম্প্রদায় প্ৰবৰ্ত্তন করে। বলরামের শিষ্যেরা তাহাকে স্ত্রীরামচন্দ্রের অবতার বলিয়া বিশ্বাস করিত। কিন্তু বলরাম স্বয়ং যে এরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছিল, এমন ৰোধ হয় না। শুনিতে পাওয়া যায়, সে স্বয়ং সৃষ্টি-স্থিতিপ্রলয়-কৰ্ত্ত বলিয়া আভাসে আপনাকে পরিচয় দ্বিত । তাহার শিষ্যেরা কহে, “বলরাম বাচক ছিলেন এবং সত্য ব্যবহার করিতে উপদেশ দিতেন। বলরাম বাক্য-চতুর ছিলেন এবং সংসারের যাবতীয় ব্যাপারের * নিগুঢ়তাব ব্যাখ্যা করিতে পারিতেন ; এই নিমিত্ত তিনি বাচক [ ૭૭૨ ] বলরামী বলিয়া প্রসিদ্ধ। এক দিবস তাহার কোন কোন শিষ্য জিজ্ঞাসা করিল, পৃথিবী কোথা হইতে হইল ? তিনি উত্তর করিলেন, 'ক্ষয় হইতে হইয়াছে। শিষ্যেরা জিজ্ঞস করিল, ক্ষয়’ হইতে রিপে হইয়াছে ? তিনি পুনরায় বিশেষ করিয়৷ বলিলেন, আদিকালে কিছুই ছিল না, আমি আপন শরীরের ক্ষয় করিয়া অর্থাৎ আপনার শীর হইতে এই পৃথিবী সৃষ্টি করি। এই নিমিত্ত ইহার নাম ক্ষিতি । ক্ষয়, ক্ষিতি ও ক্ষেত্র একই পদার্থ। লোকে আমাকে নীচ হাড়ি জাতি বলিয় জানে, কিন্তু তোমরা যে হাড়ি সচরাচর দেখিতে পাও, আমি সে হাড়ি নই। আমি কৃতদার গড়নদার হাড়ি, অর্থাৎ ষে ব্যক্তি ঘর প্রস্তুত করে তাহার নাম যেমন ঘরামী, সেইরূপ আমি হাড়ের সৃষ্টি করিয়াছি বলিয়া আমার নাম হাড়ি ।” এক দিন ৰলরাম নদীতে স্নান করিতে গিয়া দেখিল, কয়েক জন ব্রাহ্মণ তথায় পিতৃলোকের তর্পণ করিতেছেন। সেও তাহাদের স্তায় অঙ্গ-ভঙ্গী করিয়া নদী-কুলে জল সেচন করিতে লাগিল। ইহা দেখিয়া একটী ব্রাহ্মণ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বলাই তুই ও কি করিতেছিস্ ? সে উত্তর করিল, আমি শাকের ক্ষেতে জল দিতেছি। ব্রাহ্মণ কহিলেন এখানে শাকের ক্ষেত কোথায় ? বলরাম উত্তর দিল, আপনারা যে পিতৃ-লোকের তর্পণ করিতেছেন, তাহারা এখানে কোথায় ? যদি নদীর জল নদীতে নিক্ষেপ করিলে, পিতৃ-লোকের প্রাপ্ত হন, তবে নদী-কুলে জল সেচন করিলে শাকের ক্ষেতে জল না পাইবে কেন ?” দোলের সময়ে বলরাম স্বয়ং দোলমঞ্চে আরোহণ করিয়া বসিত এবং শিষ্যেরা আবীর ও পুষ্পাদি দিয়া তাহাব অর্চনা করিত । এ সম্প্রদায়ী লোকের মধ্যে জাতিভেদ প্রচলিত নাই। ইহাদের অধিকাংশই গৃহস্থ ; কেহ কেহ উদাসীন। উদাসীনের বিবাহ করে না, অথচ ইঞ্জিয়-দোষেও লিপ্ত নহে। গৃহস্থের আপন মাপন কুলাচার মতে বিবাহ-সংস্কার সম্পন্ন করিয়া থাকে। ইহাদের সাম্প্রদায়িক গ্রন্থ নাই ; বিগ্রহ সেবাও দেখিতে পাওয়া যায় না ; গুরু নাই বলিলেও হয়। ব্ৰহ্ম মালোনী নামে একটী স্ত্রীলোক ছিল, বলরাম তাহাক ভালবাসিত ; এই কারণে সে কিছুদিন গুরুর কার্য্য করিয়াছিল । , বলরামী সম্প্রদায় হ্রই শাখায় বিভক্ত। এক শাখার লোকেরা বলরামের মৃত্যু-স্থানের উপর একখানি ক্ষুদ্র ঘর প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছে ; সন্ধ্যাকালে তথায় প্রদীপ দেয় ও প্রণাম করে । দ্বিতীয় শাখার লোকেরা, বলরামের এরূপ আজ্ঞা নাই বরি তাহার মৃত্যু-স্থানের কোনরূপ গৌরব করে না ।
পাতা:বিশ্বকোষ ঊনবিংশ খণ্ড.djvu/৬৬০
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।