পাতা:বিষবৃক্ষ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

$$a বিষবৃক্ষ করিয়া ভাল করি নাই । তিনি না জানি মনে মনে আমার উপর কত রাগ করিয়াছেন। একে ত আমি তাহার মনের মধ্যে স্থান পাই নাই ; এখন আমার সকল ভরসা দূর হইল।” দেবেন্দ্রও আপন খলতাজনিত হীরার দণ্ডবিধানের মনস্কামসিদ্ধির অভিলাষ সম্পূর্ণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। মালতী দ্বারা হীরাকে ডাকাইলেন। হীরা, দুই এক দিন ইতস্ততঃ করিয়া শেষে আসিল । দেবেন্দ্র কিছুমাত্র রোষ প্রকাশ করিলেন না—ভূতপূৰ্ব্ব ঘটনার কোন উল্লেখ করিতে দিলেন না । সে সকল কথা ত্যাগ করিয়া তাহার সহিত মিষ্টান্সাপে প্রবৃত্ত হইলেন। যেমন উর্ণনাভ মক্ষিকার জন্য জাল পাতে, হীরার জন্য তেমনি দেবেন্দ্র জাল পাতিতে লাগিলেন। লুব্ধাশয়। হীরা-মক্ষিক সহজেই সেই জালে পড়িল । সে দেবেন্দ্রের মধুরালাপে মুগ্ধ এবং তাহার কৈতববাদে প্রতারিত হইল। মনে করিল, ইহাই প্রণয় ; দেবেন্দ্র তাহার প্রণয়ী। হীরা চতুরা, কিন্তু এখানে তাহার বুদ্ধি ফলোপধায়িনী হইল না। প্রাচীন কবিগণ যে শক্তিকে জিতেন্দ্রিয় মৃত্যুঞ্জয়ের সমাধিভঙ্গে ক্ষমতাশালিনী বলিয়া কীৰ্ত্তিত করিয়াছেন, সেই শক্তির প্রভাবে হীরার বুদ্ধি লোপ হইল। দেবেন্দ্র সে সকল কথা ত্যাগ করিয়া, তানপুরা লইলেন এবং সুরাপানসমুৎসাহিত হইয়া গীতারম্ভ করিলেন। তখন দৈবকণ্ঠ কৃতবিদ্য দেবেন্দ্র এরূপ সুধাময় সঙ্গীতলহরী স্বজন করিলেন যে, হীরা শ্রীতিমাত্রাত্মক হইয়। একেবারে বিমোহিত হইল। তখন তাহার হৃদয় চঞ্চল, মন দেবেন্দ্রপ্রেমবিদ্রাবিত তুইল। তখন তাহার চক্ষে দেবেন্দ্র সর্বসংসারসুন্দর, সৰ্ব্বার্থসার, রমণীর সর্বাদরণীয় বলিয়া বোধ হইল। হীরার চক্ষে প্রেমবিমুক্ত অশ্রুধারা বহিল। দেবেন্দ্র তানপুর রাখিয়া, সযত্নে আপন বসনাগ্রভাগে হীরার অশ্রুবারি মুছাইয়৷ দিলেন। হীরার শরীর পুলককণ্টকিত হইল। তখন দেবেন্দ্র, মুরাপামোদীপ্ত হইয়া, এরূপ হাস্যপরিহাসসংযুক্ত সরস সম্ভাষণ আরম্ভ করিলেন, কখনও বা এরূপ প্রণয়ীর অনুরূপ স্নেহসিক্ত, অস্পষ্টীলঙ্কারবচনে আলাপ করিতে লাগিলেন যে, জ্ঞানহীনা, অপরিমাজ্জিতবাগবুদ্ধি হীরা মনে করিল, এই স্বৰ্গ-মুখ । হীরা ত কখনও এমন কথা শুনে নাই। হীরা যদি বিমলচিত্ত হইত, এবং তাহার বুদ্ধি সংসংসর্গপরিমার্জিত হইত, তবে সে মনে করিত, এই নরক। পরে প্রেমের কথা পড়িল—প্রেম কাহাকে বলে, দেবেন্দ্র তাহা কিছুই কখন হৃদয়ঙ্গত করেন নাই—বরং হীরা জানিয়াছিল--কিন্তু দেবেন্দ্র তদ্বিষয়ে প্রাচীন কবিদিগের চর্বিতচর্বণে বিলক্ষণ পটু। দেবেশ্রের মুখে প্রেমের অনিৰ্ব্বচনীয় মহিমাকীর্তন শুনিয়া হীরা দেবেন্দ্রকে অমানুষিকচিত্তসম্পন্ন মনে করিল—স্বয়ং আপাদকবরী প্রেমরসার্জ হুইল ।