চত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ : হীরার বিষবৃক্ষের ফল ১২৩ কিছুই জানিত না—কেবল বিষবড়ির সাহায্যে লোকের প্রাণসংহার করিত। হীরা জানিত যে, সে বিষবড়ি প্রস্তুত করার জন্য উদ্ভিজ্জবিষ, খনিজ বিষ, সর্পবিষাদি নানা প্রকার সদ্যঃপ্রাণাপহারী বিষ সংগ্ৰহ করিয়া রাখিত । হীরা সেই রাত্রে তাহার ঘরে গিয় তাহাকে ডাকিয়া গোপনে বলিল যে, “একটা শিয়ালে রোজ আমার হাড়ি খাইয়া যায়। আমি সেই শিয়ালটাকে না মারিলে তিষ্ঠিতে পারি না । মনে করিয়াছি, ভাতের সঙ্গে বিষ মিশাইয়। রাখিব --সে আজি হাড়ি খাইতে আসিলে বিষ খাইয়৷ মরিবে। তোমার কাছে অনেক বিষ আছে ; সদ্যঃ প্রাণ নষ্ট হয়, এমন বিষ আমাকে বিক্রয় করিতে পার ?” চাণ্ডাল শিয়ালের গল্পে বিশ্বাস করিল না। বলিল, “আমার কাছে যাহা চাহ, তাহা আছে ; কিন্তু আমি তাহ বিক্রয় করিতে পারি না। আমি বিষ বিক্রয় করিয়াছি, জানিলে আমাকে পুলিসে ধরিবে।” হীরা কহিল, “তোমার কোন চিন্তা নাই। তুমি যে বিক্রয় করিয়াছ, ইহা কেহ জানিবে না—আমি ইষ্টদেবতা আর গঙ্গার দিব্য করিয়া বলিতেছি। দুইটা শিয়াল মরে, এতটা বিষ আমাকে দাও, আমি তোমাকে পঞ্চাশ টাকা দিব ।” - চাণ্ডাল নিশ্চিত মনে বুঝিল যে, এ কাহার প্রাণবিনাশ করিবে। কিন্তু পঞ্চাশ টাকার লোভ সংবরণ করিতে পারিল না। বিষবিক্রয়ে স্বীকৃত হইল। হীরা গৃহ হইতে টাকা আনিয়া চাণ্ডালকে দিল। চাণ্ডাল তীব্র মানুষঘাতী হলাহল কাগজে মুড়িয়া হীরাকে দিল । হীরা গমনকালে কহিল, “দেখিও, এ কথা কাহারও নিকট প্রকাশ করিও না—তাহা হইলে আমাদের উভয়েরই অমঙ্গল ।” চাণ্ডাল কহিল, “মা ! আমি তোমাকে চিনিও না।” হীরা তখন নিঃশঙ্ক হইয়া গুহে গমন করিল। গৃহে গিয়া, বিষের মোড়ক হস্তে করিয়া অনেক রোদন করিল। পরে চক্ষু মুছিয়া মনে মনে কহিল, “আমি কি দোষে বিষ খাইয়া মরিব ? যে আমাকে মারিল, আমি তাহাকে না মারিয়া আপনি মরিব কেন ? এ বিষ আমি খাইব না। যে আমার এ দশা করিয়াছে, হয় সেই ইহা খাইবে, নহিলে তাহার প্রেয়সী কুন্দনন্দিনী ইহা ভক্ষণ করিবে। ইহাদের এক জনকে মারিয়া, পরে মরিতে হয় মরিব।”
পাতা:বিষবৃক্ষ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১২৮
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।