পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/১৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১৩
মহরম পর্ব্ব—সপ্তদশ প্রবাহ

কতক্ষণ লাগিবে? আবার বিবেচনা কর, বিলম্বে কত দোষের সম্ভাবনা। মানুষের মন ক্ষণ-পরিবর্ত্তনশীল। তাহার উপর এজিদের একটু আসক্তির ভাবও পূর্ব্ব হইতেই আছে। বাধা-প্রতিবন্ধক সকলই শেষ হইয়াছে। জয়নাবও যে, আপন ভালমন্দ চিন্তা না করিতেছে, তাহাও মনে করিও না;—ওদিকে আসক্তির আকর্ষণ, এদিকেও নিরুপায় অবস্থা। এখন স্বেচ্ছার বশীভূত হইয়া এজিদের শরণাগত হইলে জয়নাব যে, স্থান পাইবে না, সে যে আদৃতা হইবে না, তাহাতে বিশ্বাস কি? শত্রুনির্য্যাতনে মনের কষ্টের প্রতিশোধ লইতেই তোমার সঙ্গে এত কথা;—এমন প্রতিজ্ঞ। জয়নাবই যদি অগ্রে যাইয়া তাহার আশ্রয় গ্রহণ করে, তবে ত তোমার সকল আশাই এই পর্য্যন্ত শেষ হইল। এদিকেও মজাইলে, ওদিকেও হারাইলে!”

 “না—না,—আমি যে আজ কাল করিয়া কয়েকদিন কাটাইয়াছি, তাহার অনেক কারণ আছে। আমি আজ আর কিছুতেই থাকিব না। লোকের কাছে কি বলিয়া মুখ দেখাইব? —হাস্‌নেবানু, জয়নাব, শাহ্‌রেবানু, এই তিন জনই আজ আমার নাম করিয়া অনেক কথা কহিয়াছে। দূর হইতে তাহাদের অঙ্গভঙ্গী ও মুখের ভাব দেখিয়াই আমি জানিয়াছি যে, সকলেই সকল কথা জানিয়াছে। কেবল হোসেনের কাণে উঠিতেই বাকী! সঙ্গে আমি কিছুই লইব না। যেখানে যাহা আছে, সকলই রহিল, এই বেশেই চলিয়া যাইব।”

 এই বলিয়াই জাএদা উঠিলেন। সেই সঙ্গে মায়মুনাও উঠিয়া তাঁহার পশ্চাদবর্ত্তিনী হইল। রাত্রি বেশী হয় নাই, অথচ হোসেনের অন্তঃপুর ঘোর নিস্তব্ধ নিশীথের ন্যায় বোধ হইতেছে। সকলেই নিস্তব্ধ। দুঃখিত অন্তরে কেহ কেহ বা বসিয়া আছেন। আকাশ তারাদলে পরিশোভিত, কিন্তু হাসান-বিরহে যেন মলিন মলিন বোধ হইতেছে। সে বোধ,—বোধ হয়, মদিনাবাসীদিগের চক্ষেই ঠেকিতেছে। বাড়ী-ঘর সকলই পড়িয়া রহিয়াছে, যে স্থানে তিনি যে কার্য্য করিতেন, তাহা কেবল কথাতেই আছে, পরিজনের মনেই আছে, কিন্তু মানুষ নাই। চন্দ্রমাও যেন মদিনাবাসীর দুঃখে দুঃখিত হইয়া, হাসানের পরিজনের দুঃখে দুঃখিত হইয়া—মলিনভাবে অস্তাচলে চলিয়া গেলেন। জাএদাও যাহার অপেক্ষায় বিলম্ব করিতেছিলেন, সে অপেক্ষা আর নাই—মনের আশা পূর্ণ