পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/১৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১৭
মহরম পর্ব্ব—অষ্টাদশ প্রবাহ

আহ্বান করিল, সন্তানের বিয়োগজনিত দুঃখ কি তখন সেই সম্ভান-বিয়োগীর মনে থাকে?—জাএদা প্রমোদ ভবনে পরিচারিকা বেষ্টিত হইয়া সুখস্বচ্ছন্দে স্বর্ণপালঞ্চে কোমল শয্যায় শুইয়া আছেন! কত কি ভাবিতেছেন! তাহার তরঙ্গ অনেক! প্রথমতঃ, দশ সহস্র স্বর্ণমুদ্রা! তারপর রাজরাণী! এই প্রথম নিশাতেই তিনি সুখ-সোপানে আরোহণ করিয়াছেন। প্রভাত হইলেই রাজদরবারে নীত হইবেন, সুখের প্রাঙ্গনে পদার্পণ করিবেন, তৎপরেই গৃহপ্রবেশ! পরমায়ুর শেষ পর্য্যন্ত সেই সুখ-নিকেতনে তিনি বাস করিবেন! মায়মুনা রাজরাণী হইবে না,—কেবল স্বর্ণমুদ্রা প্রাপ্ত হইবে মাত্র!

 জাএদার শয্যার পার্শ্বেই নিম্নতর আর একটি শয্যায় মায়মুনা শয়ন করিয়া আছে। তাহার মনে কি কোন চিন্তা নাই?—আছে। মারওয়ানের স্বীকৃত অর্থ মদিনায় বসিয়াই সে পাইতে পারিত, এতদূর আসিবার কারণ—কিছু বেশীর প্রত্যাশা। উভয়েই আপন আপন চিন্তায় চিন্তিত, উভয়েই নীরব। এদিকে নিশার কার্য্যও নিশা ভুলে নাই। ক্রমে ক্রমে উভয়েই নিদ্রার কোলে অচেতন হইলেন। একবার এই সময়ে এজিদের শয়নগৃহটি দেখিয়া আসা আবশ্যক। আজ এজিদের মনের ভাব কিরূপ? এত আশা এবং এত সুখকামনার মধ্যেও আবার কিসের মনঃ-পীড়া?

 এজিদ আজ মনের মত মনতোষিণী সুরা পান করিয়া বসিয়া আছেন, এখনও শয়ন করেন নাই। তাঁহার সম্মুখে পানপাত্র, পেয়ালা এবং মদিরাপূর্ণ-সোরাহী ধরা রহিয়াছে। রজত-প্রদীপে সুগন্ধি তৈলে আলো জ্বলিতেছে। জনপ্রাণী মাত্র সে গৃহে নাই। গৃহের দ্বারের কিঞ্চিৎ দূরে নিষ্কোষিত অসিহস্তে প্রহরী সতর্কিতভাবে পাহারা দিতেছে। মদ্যপানে অজ্ঞানতা জন্মে, সাধ্যাতীত কিছু করিতে গেলে মানব-প্রকৃতি বিকৃতি প্রাপ্ত হয়। মানুষ তখন পশু হইতেও নীচ হইয়া পড়ে। কিন্তু সাধ্য-সমতার অতীত না হইলে, বোধ হয়, অতি জঘন্য হৃদয়েও অনেক উৎকৃষ্ট ভাব আসিয়া উপস্থিত হয়। এজিদ আজ একা একা অনেক কথা বলিতেছেন। বোধ হয়, সুরাদেবীর প্রসাদে তাঁহার পূর্ব্বকৃত কার্য্য একে একে স্মরণ-পথে উদিত হইতেছে। প্রথম