পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
১৮২

বালকদ্বয়ের প্রতি অসি উত্তোলন করিতেই দয়াবতী গৃহিণী গর্ভজাত সন্তানের প্রতি সঙ্কেতে আদেশ করিলেন। আদেশমাত্র বীরপুত্র বালকদ্বয়কে বুকের মধ্যে করিয়া আঘাত ব্যর্থ করিলেন। হারেস ক্রোধে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন,—“ওরে! তুইও তোর মায়ের কথায় আমার বিরোধী হ’য়েছিস? আমার কাজে বাধা দিতে পার্‌বি না। মোস্‌লেম—পুত্রদ্বয়কে রক্ষা ক’র্‌তে পার্‌বি না—পার্‌বি না। ওরে মুর্খ! তোর জন্যও যমদূত দণ্ডায়মান। ছেড়ে দে ছোঁড়া দু’টোকে?”

 পুত্র বলিল—“কখনই ছাড়িব না। নরপিশাচ অর্থলোভীর অর্থলাভ জন্য জীবন্ত জীবকে নরব্যাঘ্রের হস্তে দিব না—দিব না।”

 “দিবি না? আচ্ছা যা, তুইও যা,—বিদ্রোহী পুত্রকে চাই না। যা বেটা জাহান্নামে যা।”

 তরবারি কম্পিত হইয়া বিজলীবৎ চমকাইল। তরবারি স্বীয় ঔরসজাত পুত্রের গ্রীবাদেশে বসিয়া আঘাতে তাহার শির ফোরাতকূলে দেহ-বিচ্ছিন্ন করিয়া দিল। গৃহিণীর চক্ষের উপর এই সকল হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটিতেছে। পালিত পুত্র, গর্ভজাত পুত্র—দুই পুত্রের খণ্ডিত দেহ মাটিতে পড়িয়া আছে। দুইটি মস্তক যেন তাঁহারই মুখের দিকে চক্ষু মেলিয়া তাকাইয়া আছে। এখনও চক্ষুর পাতা বন্ধ হয় নাই, চারিটি চক্ষু এক দৃষ্টে মায়ের মুখের দিকে চাহিয়াই আছে। এ দৃশ্য দেখিয়া গৃহিণী পুত্রদ্বয়ের কথা মনেই করিলেন না, স্বামীর ভয়ানক উগ্রমুর্ত্তি দেখিয়াও ভয় করিলেন না। বালকদ্বয়ের প্রতিই তাঁহার লক্ষ্য—কি উপায়ে তাহাদিগকে রক্ষা করিবেন, এই চিন্তাই তখন প্রবল। হারেস রক্তরঞ্জিত তরবারির দ্বারা বালকদিগের মস্তকে আঘাত করিবেন, এমন সময়ে গৃহিণী, “ও কি কর—ও কি কর” বলিয়া তরবারিসমেত স্বামীকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, “তুমি স্বামী, আমি স্ত্রী, আমি এত অনুনয়বিনয় করিতেছি, মোস্‌লেম-পুত্রদ্বয়ের শিরে অস্ত্রাঘাত করিও না। দেখ। একবার ঐ দিকে চাহিয়া দেখ! তোমার কর্ম্মফল দেখ! টাকার লোভে পুত্রসম পালিতপুত্রের প্রাণ বিনাশ করিলে। তোমার হৃদয়ের সার, কলেজার অংশ— নয়নের মণি যুবক পুত্রকে টাকার লোভে দুই খণ্ড করিলে! ভালই