পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৯৩
মহরম পর্ব্ব—চতুর্বিংশ প্রবাহ

রে দুরন্ত পাপিষ্ঠ জেয়াদ! তোর চক্রান্তে মোস্‌লেমকে হারাইলাম। তোর চক্রান্তেই আজ সপরিবারে জল-বিহনে মারা পড়িলাম।” মোস্‌লেমের জন্য হোসেন অনেক দুঃখ করিতে লাগিলেন। ওদিকে জলাভাবে তাঁহার সঙ্গিগণের মধ্যে মহাকোলাহল উপস্থিত হইল।

 প্রথমে সকলেই পিপাসাক্রান্ত হইয়া হোসেনের নিকট আসিয়া বলিতে লাগিলেন—“জলাভাবে সমস্ত লোক মরে। পিপাসায় সকলেরই শুষ্ককণ্ঠ, এক্ষণে আর কষ্ট সহ্য হয় না!”

 সকাতরে হোসেন বলিলেন, “কি করি! বিন্দুমাত্র জলও পাইবার প্রত্যাশা আর নাই। ঈশ্বরের নামামৃতপান ভিন্ন পিপাসা নিবৃত্তির আর এখন উপায় কি আছে? বিনা জলে যদি প্রাণ যায়, সকলেই সেই করুণাময় বিশ্বনাথের নাম করিয়া পিপাসা নিবৃত্তি কর। সকলেই আপন আপন স্থানে যাইয়া ঈশ্বরোপাসনায় মনোনিবেশ কর।”

 অতঃপর সকলেই পরমেশ্বরের আরাধনায় মনোনিবেশ করিলেন। ক্রমে নয় তারিখ কাটিয়া গেল। দশম দিবসের প্রাতে হোসেনের শিবিরে মহাকোলাহল উঠিল! “প্রাণ যায়, আর সহ্য হয় না!” এই প্রকার গগনভেদী শব্দ উঠিতে লাগিল। পরিবারস্থ সকলের আর্ত্তনাদে এবং কাতরস্বরে হোসেন আর তিষ্ঠিতে পারিলেন না। উপাসনায় ক্ষান্ত দিয়া হাস্‌নেবানু ও জয়নাবের বস্ত্রাবাসে যাইয়া তাঁহাদিগকে সান্ত্বনা দিতে লাগিলেন। পুত্র-কন্যা এবং অল্পবয়স্ক বালক-বালিকারা আসিয়া এক বিন্দু জলের জন্য তাঁহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল।

 শাহ্‌রেবানু দুগ্ধপোষ্য শিশুসন্তানটি ক্রোড়ে করিয়া আসিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতে লাগিলেন, “আজ সাত দিনের মধ্যে এক বিন্দু জলও স্পর্শ করিলাম না, পিপাসায় আমার জীবন শেষ হউক, তাহাতে কিছুমাত্র দুঃখ করি না; কিন্তু স্তনের দুগ্ধ পর্য্যন্ত শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। এই দুগ্ধপোষ্য শিশুর প্রাণনাশের উপক্রম হইল। এই সময়ে এক বিন্দু জল যে কোন উপায়ে ইহার কণ্ঠে প্রবেশ করাইতে পারিলেও বোধ হয় এ বাঁচিতে পারিত।”

 হোসেন বলিলেন, “জল কোথায় পাইর? এজিদের সৈন্যগণ ফোরাত নদীর কূল আবদ্ধ করিয়াছে, জল আনিতে কাহারও সাধ্য নাই!”