পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
২০৮

হইতে কবচ খুলিয়া তাঁহার হস্তে দিলেন। কাসেম সম্মানের সহিত কবচ চুম্বন করিয়া অপর পৃষ্ঠ দেখিয়াই বলিলেন, “মা! আমার আর কোন আপত্তি নাই। এই দেখুন, কবচে কি লেখা আছে।” পরিজনেরা সকলেই দেখিলেন, কবচে লেখা আছে,—“এখনই সখিনাকে বিবাহ কর।” কাসেম বলিলেন, “আর আমার কোন আপত্তি নাই, এই বেশেই বিবাহ করিয়া পিতার আজ্ঞা পালন এবং পিতৃব্যের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিব।”

 প্রিয় পাঠকগণ! ঈশ্বরানুগ্রহে লেখনীর সাহায্যে আপনাদের সহিত আমি অনেক দূর আসিয়াছি। কোন দিন ভাবি নাই, একটু চিন্তাও করি নাই, লেখনীর অবিশ্রান্ত গতিক্রমেই আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে বিষাদ-সিন্ধুর পঞ্চবিংশ প্রবাহ পর্য্যন্ত আসিয়াছি কিন্তু আজ কাসেমের বিবাহপ্রবাহে মহাবিপদে পড়িলাম! কি লিখি, কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। হাস্‌নেবানু বলিয়াছেন, “বিষাদ-সমুদ্রে আনন্দস্রোত!” এমন কঠিন বিষয় বর্ণনা করিতে আমার মস্তক ঘুরিতেছে, লেখনী অসাড় হইয়াছে, চিন্তার গতিরোধ হইয়াছে, কল্পনাশক্তি শিথিল হইয়াছে। যে শিবিরে স্ত্রী-পুরুষেরা, বালকবালিকারা দিবারাত্র মাথা ফাটাইয়া ক্রন্দন করিতেছে, পুত্র-মিত্রশোকে জগৎসংসার অন্ধকার দেখিতেছে, প্রাণপতির চিরবিরহে সতী নারীর প্রাণ ফাটিয়া যাইতেছে, ভ্রাতার বিয়োগ যন্ত্রণায় অধীর হইয়া প্রিয় ভ্রাতা বক্ষঃ বিদীর্ণ করিতেছে, শোকে তাপে স্ত্রী-পুরুষ একত্রে দিবানিশি “হায় হায়” রবে কাঁদিতেছে, জগৎকেও কাঁদাইতেছে; আবার মুহূর্ত্ত পরেই পিপাসা, সেই পিপাসারও শাস্তি হইল না;—সেই শিবিরেই আজ বিবাহ! সেই পরিজন, মধ্যেই এখন বিবাহ-উৎসব! বিষাদ-সিন্ধুতে হাসিবার কোন কথা নাই, রহস্যের নামমাত্র নাই, আমোদ-আহ্লাদের বিন্দুবিসর্গ সম্পর্কও নাই—আদ্যান্ত কেবল বিষাদ, ছত্রে ছত্রে কেবল বিষাদ, বিষাদেই আরম্ভ এবং বিষাদেই শেষ। কাসেমের ঘটনা বড় ভয়ানক। পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, মহাবীর কাসেমের ঘটনা বিষাদ-সিন্ধুর একটি প্রধান তরঙ্গ।

 কাহারও মুখে হাসি নাই, কাহারও মুখে সন্তোষের চিহ্ন নাই;