পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
২১০

প্রধান তরঙ্গ। সেই ভীষণ তরঙ্গে সকলেরই অন্তর ভাসিয়া যাইতেছিল। বরকন্যা উভয়েই সমবয়স্ক। স্বামী-স্ত্রীতে দুই দণ্ড নির্জ্জনে কথাবার্ত্তা কহিতেও আর সময় হইল না। বিবাহ-কার্য্য সম্পন্ন করিয়াই গুরুজনগণের চরণ বন্দনা করিয়া, মহাবীর কাসেম অসিহস্তে দণ্ডায়মান হইয়া বলিলেন, “এখন কাসেম শত্রুনিপাতে চলিল।”

 হাস্‌নেবানু কাসেমের মুখে শত শত চুম্বন দিয়া আর আর সকলের সহিত দুই হস্ত তুলিয়া ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিলেন, “হে রুণাময় জগদীশ্বর। কাসেমকে রক্ষা করিও, আজ কাসেম বিবাহ সজ্জা,—বাসরসজ্জা পরিত্যাগ করিয়া চিরশত্রু-সৈন্য সম্মুখে যুদ্ধসজ্জায় চলিল। পরমেশ্বর! তুমিই রক্ষাকর্ত্তা; তুমিই রণক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষক হইয়া পিতৃহীন কাসেমকে এ বিপদে রক্ষা কর!”

 কাসেম যাইতে অগ্রসর হইলেন, হাস্‌নেবানু বলিতে লাগিলেন “কাসেম! একটু অপেক্ষা কর। আমার চির মনঃসাধ আমি পূর্ণ করি। তোমাদের দুই জনকে একত্রে নির্জ্জনে বসাইয়া আমি একটু দেখিয়া লই। উভয়কে একত্রে দেখিতে আমার নিতান্তই সাধ হইয়াছে।” এই বলিয়া সখিনা ও কাসেমকে বস্ত্রাবাস মধ্যে একত্রে বসাইয়া বলিলেন, “কাসেম। তোমার স্ত্রীর নিকট হইতে বিদায় লও।” হাস্‌নেবানু শিরে করাঘাত করিতে করিতে তথা হইতে বাহির হইয়া কাসেমের গম্য পথে দাড়াইয়া রহিলেন।

 কাসেম সখিনার হস্ত ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছেন! কাহারও মুখে কোন কথা নাই। কেবল সখিনার মুখপানে চাহিয়া কাসেম স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। অনেকক্ষণ পরে কাসেম বলিলেন, “সখিনা! প্রণয়,— পরিচয়ের ভিখারী আমরা নহি; এক্ষণে নূতন সম্বন্ধে পূর্ব্ব প্রণয় নূতন ভাবে আজীবন সমভাবে রক্ষার জন্যই বিধাতা এই নূতন সম্বন্ধ সৃষ্টি করাইলেন। তুমি বীর-কন্যা—বীরজায়া; এ সময় তোমার মৌনী হইয়া থাকা আমার অধিকতর দুঃখের কারণ। পবিত্র প্রণয় ত পূর্ব্ব হইতেই ছিল, এক্ষণে তাহার উপর পরিণয়সূচক বন্ধন যুক্ত হইল। আর কি আশা কর? অস্থায়ী জগতে আর কি সুখ আছে বল ত?”