পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহরম পর্ব্ব—পঞ্চবিংশ প্রবাহ
২১১

 সখিনা বলিলেন, “কাসেম! তুমি আমাকে প্রবোধ দিতে পারিবে না। তবে এইমাত্র বলি, যেখানে শত্রুর নাম নাই, এজিদের ভয় নাই, কারবালা প্রান্তরও নাই, ফোরাত-জলের পিপাসাও যেখানে নাই, সেই স্থানে যেন আমি তোমাকে পাই; এই আমার প্রার্থণা। প্রণয় ছিল, পরিণয় হইল, আর চাই কি?”—কাসেমের হস্ত ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে সখিনা পুনঃ পুনঃ বলিলেন; “কাসেম! প্রণয় ছিল, পরিণয় হইল, আর কি আশা?”

 প্রিয়তমা ভার্য্যাকে অতি স্নেহের সহিত আলিঙ্গন করিয়া মুখের নিকটে মুখ রাখিয়া কাসেম বলিতে লাগিলেন, “আমি যুদ্ধযাত্রী, শত্রু শোণিত পিপাসু; আজ সপ্ত দিবস এক বিন্দু মাত্র জলও গ্রহণ করি নাই, কিন্তু এখন আমার ক্ষুধা-পিপাসা কিছুই নাই। তবে যে পিপাসায় কাতর হইয়া চলিলাম, বোধ হয় এ জীবনে তাহার তৃপ্তি নাই, হইবেও না। তুমি কাঁদিও না, মনের আনন্দে আমাকে বিদায় দাও। একবার কান পাতিয়া শুন দেখি, শত্রুদলের রণবাদ্য কেমন ঘোর রবে বাদিত হইতেছে! তোমার স্বামী—এই কাসেম কি ঐ বাদ্য শুনিয়া নব-বিবাহিত স্ত্রীর মুখপানে চাহিয়া বসিয়া থাকিতে পারে? সখিনা! আমি এক্ষণে বিদায় হই।”

 সখিনা বলিতে লাগিলেন—“তোমাকে ঈশ্বরের হাতে সঁপিলাম। যাও কাসেম, যুদ্ধে যাও! প্রথম মিলন-রজনীর সমাগম আশায় অস্তমিত সূর্য্যের মলিন ভাব দেখিয়া প্রফুল্ল হওয়া সখিনার ভাগ্যে নাই! যাও কাসেম!—যুদ্ধে যাও!”

 কাসেম আর সখিনার মুখের দিকে তাকাইতে পারিলেন না, স্ত্রীর আয়তলোচনের বিষাদিত ভাব চক্ষে দেখিতে আর তাঁহার ক্ষমতা হইল না; কোমল প্রাণা সখিনার সুকোমল হস্ত ধরিয়া বারংবার চুম্বন করিয়া বিদায় লইলেন। সখিনার আশা-ভরসা যে মুহূর্ত্তে অঙ্কুরিত হইল, সেই মুহূর্ত্তেই শুকাইয়া গেল। কাসেম শিবির হইতে বাহির হইয়া এক লম্ফে অশ্বে আরোহণ পূর্ব্বক সজোরে অশ্বপৃষ্ঠে কশাঘাত করিলেন। অশ্ব