পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
২৩২

হোসেন জলে নামিয়া অঞ্জলিপূর্ণ জল তুলিয়া পুনরায় ফেলিয়া দিলেন, পান করিলেন না। তদনন্তর তিনি তীরে উঠিয়া সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র, অঙ্গের বসন পর্যন্ত দূরে নিক্ষেপ করিয়া শূন্যশিরে, শূন্যশরীরে অশ্বের নিকট দণ্ডায়মান আছেন। এতদ্দর্শনে ঐ কয়েকজন একত্রে ধনুর্বাণ হস্তে হোসেনকে ঘিরিয়া ফেলিল। হোসেন স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া আছেন, কাহাকেও কিছু বলিতেছেন না। স্থিরভাবে স্থিরনেত্রে ধনুর্ধারী শত্রুদিগকে দেখিতেছেন, মুখে কোন কথা নাই। এমন নিরস্ত্র অবস্থায় শক্রহস্তে পতিত হইয়াও মনে কোনপ্রকার শঙ্কাও নাই। অন্যমনস্ক তিনি কি ভাবিতেছেন, তাহা ঈশ্বর জানেন, আর তিনিই জানেন। ক্ষণকাল পরে তিনি ফোরাত-কূল হইতে অরণ্যাভিমুখে দুই এক পদ অগ্রসর হইতে লাগিলেন। শত্রুগণ চতুষ্পর্শ্বে দূরে দূরে উঁহাকে ঘিরিয়া চলিল। যাইতে যাইতে জেয়াদ পশ্চাদ্দিক হইতে তাহার পৃষ্ঠ লক্ষ্য করিয়া এক বিষাক্ত লৌহশর নিক্ষেপ করিল। সে ভাবিয়াছিল যে, এক শরে হোসেনের পৃষ্ঠ বিদ্ধ করিয়া বক্ষঃস্থল ভেদ করিবে, কিন্তু, ঘটনাক্রমে সে শর হোসেনের বামপার্শ্ব দিয়া চলিয়া গেল, গাত্রে লাগিল না। শব্দ হইল, সে শব্দেও হোসেনের ধ্যানভঙ্গ হইল না। তাহার পর ক্রমাগতই শর নিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল, কিন্তু একটিও এমামের অঙ্গে বিদ্ধ হইল না। সীমার শর সন্ধানে বিশেষ পারদর্শী ছিল না বলিয়াই খঞ্জর[] হস্তে করিয়া যাইতেছে। এত তীর নিক্ষিপ্ত হইতেছে, একটিও হোসেনের অঙ্গে লাগিতেছে না, কি আশ্চর্য্য। সীমার—এই ভাবিয়া জেয়াদের হস্ত হইতে তীরধনু গ্রহণ পূর্বক হোসেনের পৃষ্ঠদেশ লক্ষ্য করিয়া একটি শর নিক্ষেপ করিল। তীর হোসেনের পৃষ্ঠে লাগিয়া গ্রীবাদেশের এক পার্শ্ব ভেদ করিয়া চলিয়া গেল। হোসেনের ভ্রুক্ষেপ নাই। তিনি এমন গভীর চিন্তায় নিমগ্ন আছেন যে, শরীরের বেদনা পর্য্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছেন। যাইতে যাইতে অন্যমনস্ক তিনি একবার গ্রীবাদেশের বিদ্ধস্থান হস্ত দিয়া ঘর্ষণ করিলেন; জলের ন্যায় কিছু বোধ করিলেন, করতলের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেনঃ জল নহে, গ্রীবা নিঃসৃত সদ্যরক্ত! রক্তদর্শনে হোসেন চমকিয়া উঠিলেন। আজ ভয়শূন্য মনে

  1. খঞ্জর—এক প্রকার ছোরা যাহার দুই দিকেই ধাত