পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
২৪৮

 সীমারের কর্ণে কথাগুলি বড়ই মিষ্ট বোধ হইল। আর দ্বিরুক্তি না করিয়া তিনি প্রস্তাব শ্রবণমাত্রই সম্মত হইলেন। গৃহস্বামী হোসেন-মস্তক সম্মানের সহিত স্বীয় মস্তকে লইয়া বহু সমাদরে গৃহমধ্যে রাখিয়া দিলেন। পথশ্রাস্তিহেতু সীমারের কেবল শয়নে বিলম্ব; যেমনই শয়ন, অমনই অচেতন।

 গৃহ-স্বামী বাস্তবিক হজরত মোহাম্মদ মোস্তাফার শিষ্য ছিলেন না। নানা প্রকার দেব-দেবীর আরাধনাতেই সর্বদা তিনি রত থাকিতেন। তাঁহার উপযুক্ত তিন পুত্র ও এক স্ত্রী বর্তমান। গৃহস্বামীর নাম ‘আজর’[১]। সীমারের নিদ্রার ভাব দেখিয়া, আজর স্ত্রী-পুত্রসহ হোসেনের মস্তক ঘিরিয়া বসিলেন এবং আদ্যন্ত সমুদয় ঘটনা বলিলেন।

 যে ঘটনায় পশু-পক্ষীর চোখের জল ঝরিতেছে, প্রকৃতির অন্তর ফাটিয়া যাইতেছে, সেই দেহ-বিচ্ছিন্ন হোসেন-মস্তক দেখিয়া কাহার হৃদয়ে না আঘাত লাগে? দেবদেবীর উপাসক হউন, ইসলামধর্ম্ম-বিদ্বেষীই হউন, এ নিদারুণ দুঃখের কথা শুনিলে কে না ব্যথিত হন? পিতাপুত্র সকলে একত্র হইয়া হোসেনের শোকে কাদিতে লাগিলেন।

 আজর বলিলেন, “মানুষমাত্রেই এক উপকরণে গঠিত এবং এক ঈশ্বরের সৃষ্টি। জাতিভেদ, ধর্ম্মভেদ—সেও সর্বশক্তিমান্ ভগবানের লীলা। এর জন্য পরস্পর হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণ। কেবল মূঢ়তার লক্ষণ। এমাম হাসান-হোসেনের প্রতি এজিদ যেরূপ অত্যাচার করিয়াছে, তাহা মনে করিলে হৃদয়মাত্রেরই তন্ত্রী ছিড়িয়া যায়। সে দুঃখের কথায় কোন্ চক্ষু না জলে পরিপূর্ণ হয়? মানুষের প্রতি এরূপ ঘোরতর অত্যাচার হউক, আর না হউক, জাতি ও জীবন বলিয়াও কি প্রাণে আঘাত লাগে না? সাধু, পরম ধার্মিক, বিশেষতঃ ঈশ্বরভক্ত, মহাপুরুষ মোহাম্মদের হৃদয়ের অংশ—ইহাদের এই দশা! হায়! হায়! সামান্য পশু মারিলেও কত মানুষ কাঁদিয়া গড়াগড়ি দেয়—বেদনায় অস্থির হয়, আর মানুষের জন্য মানুষ কঁদিবে না? ধর্মের বিভেদ বলিয়া মানুষের বিয়োগে মানুষ মনোবেদনা বোধ করিবে না?—

  1. হজরত ইব্রাহিম খলিলোল্লার পিতার নাম ও অজর বোত,পরস্ত ছিল। ইনি সে আজর নহেন।