পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
১০

অনুসন্ধান করিতেন, কেবল আহারের সময় বাটী আসিতেন; আহার করিয়া পুনরায় কার্য্যস্থানে গমন করিতেন। আজ জয়নাব স্বামীর আহারীয় আয়োজনে ব্যস্ত হইয়া শীঘ্র শীঘ্র রন্ধন-কার্য্য সমাধা করিলেন এবং স্বামীর সম্মুখে ভোজ্য বস্তু প্রদান করিয়া স্বহস্তে ব্যজন করিতে লাগিলেন। স্বামী যাহাতে সুখে আহার করিতে পারেন, সে পক্ষে সেই সাধ্বী সতী পরম যত্নবতী। একে উত্তপ্ত প্রদেশ, তাহাতে জ্বলন্ত অনলের উত্তাপ, এই উভয় তাপে জয়নাবের মুখখানি রক্তবর্ণ ধারণ করিয়াছে, ললাটে ও নাসিকার অগ্রভাগে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুক্তার ন্যায় ঘর্ম্মবিন্দু শোভা পাইতেছে। গণ্ডদেশ বহিয়া বুকের বসন পর্য্যন্ত ভিজিয়া গিয়াছে। পৃষ্ঠবসনের ত কথাই নাই, এত ভিজিয়াছে যে, সে সিক্তবাস ভেদ করিয়া পৃষ্ঠদেশের সুদৃশ্য কান্তি ফুটিয়া বাহির হইয়াছে। পরিহিত বস্ত্রের স্থানে স্থানে কালির চিহ্ন। এই সকল দেখিয়া আবদুল জব্বার বলিলেন, “তুমি যে বল, ঈশ্বর যে অবস্থায় রাখেন, সেই অবস্থাতেই সন্তুষ্ট থাকিতে হয়; কিন্তু তোমার এ অবস্থা দেখিয়া আমি কি প্রকারে সন্তুষ্ট থাকিতে পারি, বল দেখি? আমি যদি ধনবান হইতাম, আমার যদি কিছু অর্থের সংস্থান থাকিত, তাহা হইলে তোমার এত কষ্ট কখনই হইত না। স্থানবিশেষে, পাত্রবিশেষে ঈশ্বরের বিবেচনা নাই, এইটিই বড় দুঃখের বিষয়। তোমার এই শরীর কি আগুনের উত্তাপ সহনের যোগ্য? এই শরীরে কি এত পরিশ্রম সহ্য হয়? দেখ দেখি, এই দর্পণখানিতে মুখখানি একবার দেখ দেখি, কিরূপ দেখাইতেছে।”

 আবদুল জব্বার এই কথা বলিয়া বাম হস্তে একখানি দর্পণ লইয়া স্ত্রীর মুখের কাছে ধরিলেন। জয়নাব তৎপ্রতি লক্ষ্য না করিয়া দর্পণখানি গ্রহণ পূর্ব্বক উপবেশন-স্থানের এক পার্শ্বে রাখিয়া দিলেন। গম্ভীর বদনে বলিলেন, “স্ত্রীলোকের কার্য্য কি?”

 আবদুল জব্বার বলিলেন, “তাহা আমি জানি। আমার অবস্থা ভাল হইলে আমি অসংখ্য দাসদাসী রাখিয়া দিতাম; তাহার সকল কার্য্য করিত। তোমাকে এত পরিশ্রম, এত কষ্ট কখনই সহ্য করিতে হইত না।”

 জয়নাব বলিলেন, “আপনি যাহাই বলুন, আমি তাহাতে সুখী হইতাম