পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৫৩
উদ্ধার পর্ব্ব—দ্বিতীয় প্রবাহ

 আজর স্ত্রীপুত্রগণের নিকট যাইয়া বিষন্নভাবে বলিলেন, “হোসেনের মস্তক রাখিতে সঙ্কল্প করিয়াছিলাম, তাহা বুঝি ঘটিল না। মস্তক না লইয়া সৈনিকপুরুষ কিছুতেই যাইতে চাহে না, আমি তোমাদের সাহায্যে সৈনিক পুরুষের ইহকালের মত লক্ষ টাকা প্রাপ্তির আশা এই স্থান হইতে মিটাইয়া দিতে পারিতাম। কিন্তু আমি স্বয়ং যাচ্ঞা করিয়া হোসেনের মস্তক আপন তত্ত্বাবধানে রাখিয়াছি। আবার সেও বিশ্বাস করিয়া আমার হস্তে ইহা সমর্পণ করিয়াছে। এ অবস্থায় উহার প্রাণবধ করিলে সম্পূর্ণ বিশ্বাসঘাতকতার সহিত নরহত্যা-পাপ পঙ্কিলে ডুবিতে হয়! রাজ-অনুচর, রাজকর্ম্মচারী, রাজাশ্রিত লোককে, প্রজা হইয়া প্রাণে মারা, সেও মহাপাপ। আমার স্থির সিদ্ধান্ত এই যে, নিজ মস্তক স্কন্ধোপরি রাখিয়া হোসেনের মস্তক সৈনিক-হস্তে কখনই দিব না। তোমরা ঐ খড়্গ‌ দ্বারা আমার মস্তক দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া সৈনিকের হস্তে দাও, সে বর্শায় ইহা বিদ্ধ করুক। খণ্ডিত-শির প্রাপ্ত হইলে তিলার্দ্ধকালও সে এখানে থাকিবে না বলিয়াছে। তোমরা যত্নের সহিত হোসেনের মস্তক কারবালায় লইয়া, তাঁহার দেহ সন্ধান করিয়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার উদ্যোগ করিবে, এই আমার শেষ উপদেশ। সাবধান! কেহ ইহার অন্যথা করিও না।

 আজরের জেষ্ঠপুত্র সায়াদ বলিতে লাগিল, “পিতঃ। আমরা ভ্রাতৃত্রয় বর্তমান থাকিতে আপনার মস্তক দেহ-বিচ্ছিন্ন হইবে? এ কি কথা? আমরা কি পিতার উপযুক্ত পুত্র নহি? আমাদের অন্তরে কি পিতৃভক্তির কণামাত্রও স্থান পায় নাই? আমরা কি এমনই নরাকার পশু যে, স্বহস্তে পিতৃমস্তক ছিন্ন করিব? ধিক্‌ আমাদের জীবনে! ধিক্‌ আমাদের মনুষ্যত্বে! যে পিতার ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়া জগতের মুখ দেখিয়াছি, মানুষের পরিচয়ে মানুষের সহিত মিশিয়াছি, সেই পিতার শির যে কারণে দেহবিচ্ছিন্ন হইবে, সে কারণের উপকরণ কি আমরা হইতে পারিব না? পিতঃ! আর বিলম্ব করিবেন না, খণ্ডিত মস্তক প্রাপ্ত হইলেই যদি সৈনিকপুরুষ চলিয়া যায়, তবে আমার মস্তক লইয়া তাহার হস্তে ন্যস্ত করুন। সকল গোল মিটিয়া যাউক।”