পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
২৬২

মস্তক দেখিয়া প্রথমে ঈশ্বরের নাম, পরে নূরনবী মোহাম্মদের গুণানুবাদ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “ঈশ্বর! তোমার মহিমা অসীম, তুমি সকলই পার। দোহাই ঈশ্বর! বিলম্ব সহে না,—দোহাই ভগবান্! আর সহ্য হয় না, একেবারে সপ্ততল আকাশ ভগ্ন করিয়া আমাদের উপর নিক্ষেপ কর। দয়াময়! আমাদের চক্ষের জ্যোতিঃ হরণ কর, বজ্রাস্ত্র কোন্ সময় ব্যবহার করিবে? দয়াময়। আর সহ্য হয় না; এজিদের দৌরাত্ম আর সহিতে পারি না। দয়াময়! সকল অবস্থাতেই তোমাকে ধন্যবাদ দিয়াছি, এখনও দিতেছি। সকল সময়ে তোমার প্রতি নির্ভর করিয়াছি, এখনও করিতেছি; কিন্তু দয়াময়! এ দৃশ্য আর দেখিতে পারি না। আমাদের চক্ষু অন্ধ হউক, কর্ণ বধির হউক, এজিদের অমানুষিক কথা যেন আর শুনিতে হয়। দয়াময়! আর কাঁদিব না। তোমাতেই আত্মসমর্পণ করিলাম।”

 কি আশ্চর্য! সেই মহাশক্তিসম্পন্ন মহাকৌশলীর লীলা অবক্তব্য। পাত্রস্থ শির ক্রমে শূন্যে উঠিতে লাগিল। এজিদ এ দৃশ্য স্বচক্ষে দেখিতেছেন, অথচ কিছুই বলিতে পারিতেছেন না। কে যেন তাহার বাক্-শক্তি হরণ করিয়া লইয়াছে। পরিজনেরা সকলেই দেখিলেন; হোসেনের মস্তক হইতে পবিত্র জ্যোতিঃ বহির্গত হইয়া যেন আকাশের সহিত সংলগ্ন হইয়াছে। খণ্ডিতশির জ্যোতিঃর আকর্ষণে উর্ধ্বে উঠিতে লাগিল এবং দেখিতে দেখিতে অন্তর্ধান হইল।

 এজিদ সভয়ে গৃহের উর্দ্ধভাগে বারবার দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন; দেখিলেন কোথাও কিছু নাই। পাত্রের প্রতি তিনি দৃষ্টিপাত করিলেন; দেখিলেনঃ শূন্য পাত্র পড়িয়া আছে। যে মস্তক লইয়া কত খেলা করিবেন, হোসেন-পরিবারের সম্মুখে কত প্রকার বিদ্রুপ করিয়া হাসি-তামাসা করিবেন, তাহা আর হইল না। হোসেন-মস্তক কে লইল, তাহা কেন উর্দ্ধে উঠিয়া একেবারে অন্তর্ধান হইল, এত জ্যোতিঃ, এত তেজ, তেজের এত আকর্ষণ-শক্তি কোথা হইতে আসিল? এজিদ ভাবিতে ভাবিতে হতবুদ্ধি প্রায় হইলেন, কোনই কারণ খুঁজিয়া পাইলেন নো। কেবল একটি অপূর্ব সৌরভ কতক্ষণ পর্যন্ত রাজভবন আমোদিত করিয়াছিল, তাহাই বুঝিতে পারিলেন।