পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৩৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
৩১২

 আজ সীমারের অন্তরে নানা চিন্তা। এ চিন্তার ভাব ভিন্ন, আকার ভিন্ন, প্রকার ভিন্ন। কারণ, সুখের চিন্তার ইয়ত্তা নাই, সীমা নাই, শেষ নাই। যে কার্য্যভার মস্তকে গ্রহণ করিয়া দামেস্ক হইতে সীমার যাত্রা করিয়াছিল, সে সর্ব্বতোভাবেই তাহাতে কৃতকার্য্য হইয়াছে। তাহার মনে আনন্দের তুফান উঠিয়াছে, তরঙ্গের উপর তরঙ্গ উঠিয়া মহা গোলযোগ করিতেছে। ধনলাভ, মর্য্যাদাবৃদ্ধি, কি পদবৃদ্ধি— কি হইবে, কি চাহিবেন, কি গ্রহণ করিবেন, সীমার তাহার কিছুই স্থির করিতে পারিতেছে না। রাত্রি প্রভাত হইল। জগৎ জাগিল। প্রথমে পাখীকুল, শেষে মানবগণ বিশ্বরঞ্জন বিশ্বপতির নাম মুখে করিয়া জাগিয়া উঠিল। পূর্ব্বগগনে রবিদেব আরক্তিম লোচনে দেখা দিলেন। গত দিবাবসানে যে কারণে তিনি মলিনমুখ হইয়া অস্তাচলে মুখ ঢাকিয়াছিলেন, আজ যেন সে ভাব নাই। আজ তিনি ঘোর লোহিতবর্ণ, অসীম তাঁহার তেজ।—দেখিতে দেখিতে তিনি প্রখর কিরণ বিকীর্ণ করিয়া ক্রমে অগ্রসর হইতে লাগিলেন।

 সীমার দামেস্ক-যাত্রার আয়োজনে ব্যস্ত,সৈন্যগণ সাজিতেছে, অশ্ব সকল সজ্জিত হইয়া আরোহীর অপেক্ষায় রহিয়াছে; বাজনার রোল ক্রমেই বাড়িতেছে, বিজয় নিশান উচ্চ শ্রেণীতে উর্দ্ধে উঠিয়া ক্রীড়া করিতেছে। এমন সময়ে যেন রবিদেবের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিমূর্ত্তির সহিত পূর্ব্ব দিকে প্রায় লক্ষাধিক সশস্ত্র দেবমূর্ত্তির আবির্ভাব। কি দৃশ্য! কি চমৎকার বেশ! স্বর্ণ-রজত নির্ম্মিত দণ্ডে কারুকার্য্য খচিত পতাকা! অশ্বপদ-বিক্ষেপের শ্রীই বা কি মনোহর! অস্ত্রের চাক্‌চিক্য আরও মনোহর, সূর্য্যতেজে অতি চমৎকার দৃশ্য ধারণ করিয়াছে। সীমার আশ্চর্য্যান্বিত হইল। পতাকার চিহ্ন দেখিতে দেখিতে তাহার বদনে বিষাদ-কালিমা রেখার মত শত শত চিহ্ন বসিয়া গেল; তাহার অঙ্গ শিহরিয়া উঠিল; হৃদয় কাঁপিতে লাগিল; চঞ্চল অক্ষি স্থির হইল। মুখে সীমার বলিল, “এ কাহার সৈন্য? এ যে নূতন বেশ, নুতন আকৃতি, নূতন সাজ! উষ্ট্রোপরি ডঙ্কা, নাকাড়া। নিশান-দণ্ড উষ্ট্রপৃষ্ঠে দণ্ডায়মান, আকার প্রকারে বীরভাবের পরিচয় দিতেছে! বংশীরবে উষ্ট্রসকল মনের আনন্দে নাচিতে নাচিতে আসিতেছে। ইহারা কাহারা? ইহারা কাহার সৈন্য?