পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৩৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
৩৩৬

প্রাণের মায়া কাহার না আছে? আজ সীমারের চক্ষে জল পড়িল, আজ পাষাণ গলিল। পূর্ব্বকৃত প্রতি মুহূর্ত্তের পাপকার্য্যের ভীষণ ছবি তাহার মনে উদিত হইল। পাপময় জীবনের নিদারুণ ভীষণ পাপছায়া তখন সীমারের চক্ষের উপর ঘুরিতে লাগিল, জলবিন্দুর সহিত শরীরের রক্তবিন্দু ঝরিতে লাগিল। সীমার ঊর্দ্ধদৃষ্টিতে আকাশ পানে চাহিয়া হোসেনের প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়া জীবন-শেষের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। শরীরের মাংসসকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে দেহস্খলিত হইয়া মৃত্তিকায় পড়িতেছে—তথায় সীমারের প্রাণ দেহ পিঞ্জরে ঘুরিতেছে। মস হাব কাক্কা প্রভৃতি দ্বিগুণ জোরে শর-নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। সীমারের শরীরের গ্রন্থিসকল ছিন্ন হইয়া পড়িতে আরম্ভ হইল, তবু প্রাণ বাহির হয় না। কি কঠিন প্রাণ। তখন সীমার ঊর্দ্ধদৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল “হে ঈশ্বর! আমার পাপের কি প্রায়শ্চিত্ত নাই? আমার শরীরের মাংসখণ্ড প্রায় স্খলিত হইয়া পড়িল, অস্থিসকল জরজর হইয়া ভগ্ন হইয়া গেল, তবু প্রাণ বাহির হইল না। হে দয়াময়! আমিও তোমার সৃষ্ট জীব, আমার প্রতি কটাক্ষপাত কর, আমার প্রাণবায়ু শীঘ্রই হোসেনের পদপ্রান্তে নীত কর।”

 মোহাম্মদ হানিফা এবং মস্‌হাব কাক্কা এই কাতরপূর্ণ প্রার্থনা শুনিয়া শরাসনে জ্যা শিথিল করিলেন, আর তুণীরে হস্ত নিক্ষেপ করিলেন না। সকলেই দয়াময়ের নাম করিয়া শত সহস্র প্রকারে তাঁহার গুণানুবাদ করিলেন। ক্রমে সীমারের প্রাণবায়ু ইহজগৎ হইতে অনন্ত আকাশে মিশিয়া হোসেনের পদপ্রান্তে আশ্রয় গ্রহণ করিল।

 বীরকেশরিগণ আর সীমারের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করিলেন না; শিবিরে আসিয়া মদিনায় যাইতে প্রস্তুত হইলেন। ওত বে অলীদ বিষন্ন বদনে দামেস্কাভিমুখে যাত্রা করিল। যে আশা তাহার অন্তরে জাগিতেছিল, সে আশা আশা-মরীচিকাবৎ ঐ প্রান্তরের বালুকা-কণা মধ্যে মিশিয়া গেল। মনে মনেই সে বুঝিল, সীমারের সৈন্যগণ মস্‌হাব কাক্কার অধীনতা স্বীকার করিয়াছে। আর আশা কি? এ প্রান্তরে আর আশা কি?