পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৪৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৩৭
উদ্ধার পর্ব্ব—ত্রিংশ প্রবাহ

পদরিক্ষেপ কর, বজ্রনাদে আক্রমণ কর, অশনিবৎ অস্ত্রের ব্যবহার কর। আমরাও গাজী রহ্‌মানের দেহ সহস্র খণ্ডে খণ্ডিত করিয়া শৃগাল কুকুর দ্বারা ভক্ষণ করাইব। কর আঘাত! কর আঘাত!!”

 যেমনি সম্মিলন, অমনি অস্ত্রের বর্ষণ। কি ভয়ানক যুদ্ধ! কি ভীষণ কাণ্ড!! প্রান্তরময় সৈন্য, প্রান্তরময় অস্ত্র, প্রান্তরময় সমর! উভয় দলেরই আঘাত প্রতিঘাত আরম্ভ হইল। অসি, বর্শা, খঞ্জর, তরবারি—সকলই চলিল। কি ভয়ানক ব্যাপার! যে যাহাকে সম্মুখে পাইতেছে, সেই-ই তাহার প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করিতেছে। পরিচয় নাই, পাত্রপাত্র প্রভেদ নাই। সম্মিলন স্থলে উভয় দলে যে বাধা জন্মিয়াছে, তাহাতে কোন পক্ষেরই আর অগ্রসর হইবার ক্ষমতা হইতেছে না। কেবল সৈন্যক্ষয়—বলক্ষয় হইতেছে মাত্র। ওমর আলী, মস্‌হাব কাক্কা প্রভৃতি দুই এক পদ অগ্রসর হইতেছেন, কিন্তু টিঁকিতে পারিতেছেন না। মোহাম্মদ হানিফা এখনও তরবারি ধরেন নাই, কেবল সৈন্যদিগকে উৎসাহ দিতেছেন, মুহুর্ত্তে মুহূর্ত্তে ভৈরব নিনাদে দামেস্ক-প্রান্তর কাঁপাইয়া তুলিতেছেন। সৈন্যগণ সময় সময় “আল্লাহু আকবর” শব্দ করিয়া গগন পর্য্যন্ত কাঁপাইয়া তুলিতেছে।

 এখনও মোহাম্মদ হানিফা তরবারি ধরিলেন না। দুল্‌দুলে কশাঘাত করিয়া তিনি কেবল সৈন্য-শ্রেণীর এক সীমা হইতে অন্য সীমা পর্য্যন্ত মুহূর্ত্তে মুহুর্ত্তে ঘুরিয়া দেখিতেছেন। যেখানে একটু মন্দভাবে তরবারি চলিতেছে, সেইখানেই—সেই দলেই তিনি পৃষ্ঠপোষক হইয়া দুই চারিটি কথা কহিয়া কাফের-বধে উৎসাহ দিতেছেন। কি লোমহর্মণ সমর! কি ভয়ানক সমর!! বিনা মেঘে বিজলী খেলিতেছে (অস্ত্রের চাকচিক্য), হুহুঙ্কারে গর্জ্জন হইতেছে (উভয় দলের সৈন্যগণের বিকট শব্দ),অজস্র শিলার বর্ষণ হইতেছে (খণ্ডিত দেহ), মুষলধারে বৃষ্টি হইতেছে (দেহ-নির্গত রুধির)—কি দুর্দ্ধর্ষ সমর।

 বেতনভোগী সৈন্যগণ—ইহারা হানিফার কে, এজিদেরই বা কে? হায় রে অর্থ! হায় রে হিংসা! হায় রে ক্রোধ! হানিফার সৈন্যগণ আজ অজ্ঞান; মদিনাবাসীরা বিহ্বল; পদতলে—অশ্ব-পদতলে নরদেহ, নরশোণিত! ক্রমেই খণ্ডিত দেহ, খণ্ডিত অশ্ব,—বিষম সমর।