পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
৩০

সকলেরই দুঃখ! কিন্তু স্বভাব কাহারও কথায় কর্ণপাত করে না! প্রণয়ীর প্রতি অথবা প্রণয়ের প্রতিও ফিরিয়া তাকায় না। বিরহীর দুঃখেও দুঃখিত হয় না! সময় যে নিয়মে যাইতেছে, সেই নিয়মে কত দিন যাইবে, তাহা কে বলিতে পারে? এজিদের মনে কত কথাই উদয় হইতেছে। কথা ভাঙ্গিবার একমাত্র দোসর মারওয়ান! সে মারওয়ানও এক্ষণে উপস্থিত নাই। তাই নানা প্রকার চিন্তায় তিনি চিন্তিত।

 মাবিয়া পীড়িত। তাঁহার ব্যাধি সাংঘাতিক, বাঁচিবার আশা অতি কম। এজিদের সেদিকে দৃকপাত নাই, পিতার সেবা-শুশ্রূষাতেও মন নাই। প্রস্ফুটিত গোলাপদল-বিনিন্দিত জয়নাবের সুকোমল বদনমণ্ডলের আভা, সেই আয়তলোচনার নয়নভঙ্গীর সুদৃশ্য দৃশ্য—দিবারাত্র তাঁহার অন্তরপটে আঁকা। জয়নাবের ভ্রূ-যুগলের অগ্রভাগ, যাহা সুতীক্ষ বাণের ন্যায় তাঁহার অন্তর ভেদ করিয়া অন্তরে রহিয়াছে, দিবারাত্র তিনি সেই বিষেই বিষম কাতর! সেই নাসিকার সরল ভঙ্গিমায় সর্ব্বদাই আকুল! সেই ঈষৎ লোহিত অধরোষ্ঠ পুনঃ পুনঃ দেখিবার আশা সততই তাঁহার বলবতী! আজ পর্য্যন্ত তিনি সেই চিকুরগুচ্ছের লহরীশোভা ভুলিতে পারেন নাই। সামান্য অলঙ্কার, যাহা জয়নাবের কর্ণে দুলিতে দেখিয়াছেন, সেই দোলায় তাঁহার মস্তক আজও পর্য্যন্ত অবিশ্রান্তভাবে দুলিতেছে। জয়নাবের ললাটের উপরিস্থিত মালার জালি[১] অর্দ্ধচন্দ্রাকারে চিকুরের সহিত মিলিত হইয়া যাহার কিঞ্চিৎভাগ ললাটের শোভাবর্দ্ধন করিয়াছিল, তাঁহার মনঃপ্রাণ সেই জালে আটক পড়িয়া আজ প্যর্যন্ত ছট্‌ফট্‌ করিতেছে। সেই হাসিপূর্ণ মুখখানির হাসির আভা, জয়নাবের অজ্ঞাতে একবার তিনি দেখিয়াছেন। কতবার তিনি নিদ্রা গিয়াছেন, কত শতবার চক্ষের পলক ফেলিয়াছেন, তথাপি সেই মধুর হাসির আভাটুকু আজ পর্য্যন্তও তাঁহার চক্ষের নিকট হইতে সরিয়া যায় নাই, মনে সদাই জাগিতেছে।

 মোস্‌লেম আসিলেই জয়নাবের কথা শুনিবেন! কত আগ্রহে জয়নাব তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়াছে, কথার ছলে, সেই কথাটি অন্ততঃ দুইবার তিনবার দোহোরাইয়া শুনিবেন! কি ভাবে বলিয়াছিল, মোস্‌লেমকে বার


  1. জালি—আরবদেশীয় অলঙ্কার