পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৪৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
৪৫৬

 প্রভু হোসেনের কথা, কারবালা প্রান্তরে এক বিন্দু জলের কথা, হােসেনের ক্রোড়স্থিত শিশুসন্তানের কোমল বক্ষ ভেদ করিয়া লৌহ তীর প্রবেশের কথা মনে হইয়া হানিফার প্রাণ আকুল করিয়াছে! বিস্ফারিত চক্ষে রােষাগ্নির তেজ বহিয়া অবশেষে বাষ্পরাশি বহাইয়া তাহাকে এক প্রকার উন্মাদের ন্যায় করিয়া তুলিয়াছে। “কৈ এজিদ! কৈ সে দুরাত্মা এজিদ! কৈ সে নরাধম এজিদ!—কৈ এজিদ! কৈ এজিদ!” মুখে বলিতে বলিতে এজিদ-অন্বেষণে তিনি অশ্বে কশাঘাত করিয়াছেন। সে মুর্ত্তি এজিদের চক্ষে পড়িতেই এজিদ ভাবিয়াছিলেন যে, এ মহাকালের হস্ত হইতে আত্মরক্ষা নাই, অতএব পলায়নই শ্রেয়ঃ। বীরের ন্যায় বক্ষবিস্তারে হানিফার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া, “আমি এজিদ—আমিই সেই মদিনার মহাবীরগণের কালস্বরূপ এজিদ! হানিফা! আইস, তোমাকে ভবন্ত্রণার দায় হইতে মুক্ত করিয়া দিই।”—এই সকল কথা বলা দূরে থাকুক, যেই দেখা অমনই এজিদের পলায়নের চেষ্টা; প্রাণভয়ে পলায়নের চেষ্টা!—প্রাণ-ভয়ে দামেস্করাজ অশ্বারােহণ করিয়া যথাসাধ্য বেগে অশ্ব চালাইতেছেন।

 হানিফাও এজিদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ দুলদুল্ চালাইয়াছেন। এই দৃশ্য অনেকেই দেখেন নাই। রণরঙ্গে মাতােয়ারা বীর সকল একথা অনেকেই শুনেন নাই। যাঁহারা দেখিয়াছেন, যাঁহারা শুনিয়াছেন, তাঁহারাও তাহার পর কি ঘটিয়াছে, কি হইয়াছে, এ পর্য্যন্ত তাহার কোন সন্ধান প্রাপ্ত হন নাই। কোন সন্ধানীও সন্ধান আনিতে পারে নাই।

 এদিকে মস্‌হাব কাক্কা, ওমর আলী, আক্কেল আলী (বাহ্‌রাম) প্রভৃতি মহামহিম যােদ্ধাসকল কাফেরদিগকে পশুপক্ষীর ন্যায় যথেচ্ছা বধ করিতে করিতে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। গাজী রহ্‌মানের পূর্ব্ববচন সফল হইল। এজিদ-সৈন্য প্রাণভয়ে পলাইয়াও প্রাণরক্ষা করিতে পারিতেছে না। অশ্বের দাপটে, তরবারির আঘাতে, বর্শার সূক্ষাগ্রে, তীরের লক্ষ্যে, গদার প্রহারে, খঞ্জরের আঘাতে তাহারা প্রাণ হারাইতেছে। কত শিবির, কত চন্দ্রাতপ, কত উষ্ট্র, কত অস্ত্র, প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখায় হুহু শব্দে পুড়িয়া ছাই হইতেছে। এজিদ পক্ষের জীবন্ত প্রাণী আর কাহারও চক্ষে পড়িতেছে না। দৈবাৎ