পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৪৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৫৭
এজিদ বধ পর্ব্ব—দ্বিতীয় প্রবাহ

কাহারও দেখা পাইলে ‘মার্ মার্’ শব্দে চারিদিক হইতে হানিফার সৈন্যগণ তাহাকে ঘিরিয়া, ক্রীড়া-কৌতুক, হাসি-রহস্য করিয়া মারিয়া ফেলিতেছে। ক্রোধের ইতি নাই, ‘মার্ মার্’ শব্দের বিরাম নাই। সময়ে সময়ে মুখে এই হৃদয়বিদারক, মর্ম্মঘাতী কথা কহিয়া নিজেরাও কাঁদিতেছে, জগৎকেও কাঁদাইতেছে। হায় হাসান! হায় হােসেন! তােমরা আজ কোথায়? সে মহাপ্রান্তর কার্‌বালা কোথায়? ফোরাতের উপকূল কোথায়? যে সৈন্যদল ফোরাতের জল লইতে পথ বন্ধ করিয়াছিল, তাহারাই বা আজ কোথায়? কৈ এজিদের সৈন্য? কৈ এজিদ? কৈ তাহার শিবির? কিছুই ত চক্ষে দেখিতেছি না। প্রভু হােসেন! তুমি কোথায়? এ দৃশ্য তােমাকে দেখাইতে পারিলাম না। আহো কাসেম! মদিনার শ্রেষ্ঠ বীর কাসেম। একবিন্দু জলের জন্য, হায়! হায়!! একবিন্দু জলের জন্য কি না ঘটিয়াছে। উহু!। কি নিদারুণ কথা! পিপাসায় কাতর হইয়া প্রভুপুত্র আলী আকবর পিতার জিহ্বা চুষিয়াছিল। হায়! হায়!! সে দুঃখ ত কিছুতেই যায় না। কারবালার কথা কিছুতেই ভুলিতে পারিতেছি না। সে দিন রক্তের ধারা ছুটিয়া কারবালা-প্রান্তর ডুবিয়াছে। আজ দামেস্ক-প্রান্তর দামেস্ক-সৈন্য়-শােণিতে ডুবিতেছে, দামেস্করাজা মদিনার সৈন্য-পদতলে দলিত হইতেছে। কিন্তু আশা মিটিতেছে না, সে মনােবেদনার অণুমাত্রও উপশমবােধ হইতেছে না। বুঝিলাম—হােসেনশােক অন্তর হইতে অন্তর হইবার নহে; মানিলাম,—কারবালার ঘটনা, মদিনাতে মায়মুনার কীর্ত্তি ও জাএদার আচরণ জগৎ হইতে একেবারে যাইবার নহে! চন্দ্র, সূর্য্য, তারা, নক্ষত্র যতদিন জগতে থাকিবে, ততদিন তাহা সকলের মনে সমভাবে জ্বলন্তরূপে বিষাদ-কালিমারেখায় অঙ্কিত থাকিবে।

 সমরাঙ্গণে অস্ত্রাগ্নি নির্ব্বাণ হইয়াছে, কিন্তু আগুন জ্বলিতেছে। উর্দ্ধে অগ্নিশিখা—নিম্নে রক্তের লেখা। রক্তমাখা দেহসকল রক্তস্রোতেই ভাসিতেছে, ডুবিতেছে, গড়াইয়া যাইতেছে।

 সৈন্যদলসহ মস্‌হাব কাক্কা প্রভৃতি সকলে নগরের নিকট পর্য্যন্ত আসিলেন। শত্রুপক্ষীয় একটি প্রাণীও তাঁহাদের চক্ষে আর পড়িল না। জয়নাল আবেদীনসহ গাজী রহ্‌মান নগরের প্রবেশদ্বার পর্য্যন্ত যাইয়া হানিফার অপেক্ষা