পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৪৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৭৫
এজিদ বধ পর্ব্ব—তৃতীয় প্রবাহ

দিন আমার মস্তকোপরি চিকুর-সংলগ্ন মুক্তার জালি ছিল, কর্ণে কর্ণাভরণ দুলিতেছিল। ছিঃ ছিঃ! কেন গবাক্ষদ্বার খুলিয়া দাঁড়াইয়াছিলাম, সেই কূলক্ষণযুক্ত গবাক্ষ-দ্বারে অবস্থানই আমার কাল হইয়াছিল! এই মহা দুর্ঘটনার কারণই গবাক্ষ-দ্বারে আমার অবস্থান,—বিনা আবরণে মস্তক উলঙ্গ করিয়া দণ্ডায়মান। এখন বুঝিলাম, সেই শাহীনামার মর্ম্ম! এখন বুঝিলাম: রাজ-প্রাসাদে আবদুল জব্বারের আহ্বানের অর্থ! এখন বুঝিলাম: সামান্য দরিদ্র-গৃহে রাজ-কাসেদের শাহীনামা লইয়া গমন, আবদুল জব্বারের নিমন্ত্রণের মন্ত্রণা,— সকলই চাতুরী। এরূপ আহ্বান, আদর, সমাদর, নামা প্রেরণ, সকলই আমার জন্য। এজিদের চাতুরী আবদুল জব্বার কি বুঝিবে? রাজ-জামাতা হইয়া আশার অতিরিক্ত সুখভোগ করিবে, সামান্য ব্যবসায়ী —সামান্য অর্থের জন্য যে লালায়িত—সে রাজকুমারী সালেহাকে লাভ করিয়া জীয়ন্তে স্বর্গসুখ ভোগ করিবে, নরললাকে বাস করিয়া স্বর্গীয় অপ্সরার সহিত মিলিত হইয়া পরমাত্মাকে শীতল করিয়া সুখী হইবে! সেই আশাতেই আমাকে বিনা অপরাধে আবদুল জব্বার পরিত্যাগ করিল। কি নিষ্ঠুর! কি নির্দ্দয়!— কি কপট। সেই শাহীনামা প্রাপ্তির পূর্ব্বক্ষণ পর্য্যন্ত আমার দুঃখ দেখিয়া তাহার কত আক্ষেপ, কত মনোবেদনা প্রকাশ!—কি কপট! রন্ধনশালার কার্য্যে অগ্নির উত্তাপে আমার মুখের ঘর্ম্ম-বিন্দু মুক্তা-বিন্দু আকারে ফুটিয়াছিল!—ছাই-কয়লার কালি বস্ত্রে—হস্তে লাগিয়াছিল! সম্মুখে দর্পণ ধরিয়া দর্পণে আমার ছায়া আমাকে দেখান হইল! বলা হইল—“টাকা থাকিলে কি এত দুঃখ তোমার হয়? আমার প্রাণে কি ইহা সহ্য হয়?” কত প্রকার আক্ষেপ আবদুল জব্বার করিয়াছিল, তাহার প্রত্যক্ষ ফল সে হাতে হাতে দেখাইল। সেই দিনই তাহার দামেস্কে যাত্রা।—রাজপ্রাসাদে সে সাদরে গৃহীত। যেমনই প্রস্তাব, অমনই অনুমোদন—আমাকে পরিত্যাগ! ধন্য বিবি সালেহা! স্পষ্টই তিনি উত্তর করিলেন: এক স্ত্রীর সহিত যখন এই ব্যবহার—অর্থলোভে চিরপ্রণয়ী প্রিয়-পত্নীকে পরিত্যাগ,—তখন আর বিশ্বাস কি? আবদুল জব্বারের সহিত তাঁহার বিবাহে অস্বীকার—যেমন কর্ম্ম তেমনই ফল! এজিদেরই জয়! এজিদেরই মনোবাসনা পূর্ণ!—কৌশলে জয়নাবকে হস্তগত