পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৫০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৮৭
এজিদ বধ পব্ব- চতুথ প্রবাহ

আমি অনায়াসেই অন্ধকায়ে চলিতে পারি। আজিকার অন্তই আমায় কাজ অজীবন রক্ষার একমাত্র উপায়।

 এই সকল চিন্তা শ্রেণীবদ্ধরূপে যে এজিদের মনে উদয় হইয়াছিল, তা নহে। মৃত্যুর পূর্বের পূর্ব লক্ষণ—ক্ষণকাল বিকার, ক্ষণকাল অজ্ঞান, ক্ষণকাল ঘোর অচৈতন্যভার! ক্ষণকাল সজ্ঞান সময়টুকুর মধ্যে চিন্তার ঢেউ ঐরূপে সময়ে সময়ে এজিদের মনে উঠিতেছিল। এজিদ হন্তু হইতে অশ্ববল্প। ছাড়িয়া দিলেন। অশে সজোরে কশাঘাত করিতে লাগিলেন। এখন আর দিগ্বিদিক জ্ঞান নাই। অশের স্বেচ্ছাধীন গতিই তাঁহার গতি। মনোমত পথই তাহার বাঁচিবার পথ—আর অশ্বকে দক্ষিণে বামে ফিরাইয়া পলাইবার চেষ্টা করিতেছেন না। ঘোড় আপন ইচ্ছামত ছুটিয়াছে।

 হানিফা কিঞ্চিৎ দুরে পড়িলেন। উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন— “এজিদ! হানিফার হস্ত হইতে আজি তোর নিস্তার নাই। কিন্তু এক্ষিণ! এ অবস্থায় তোকে প্রাণে মারিব না, জীবন্ত ধরিব তোর খণ্ডিত শিরে ধরালুষ্টিত ভার, শিশুশ দেহের স্বাভাবিক ক্রিয়ার দৃশ্য,হানিফা একা দেখিতে ইচ্ছা করে না। বিশেষতঃ বীৱেৱ আঘাত চারি চক্ষু একত্র করিয়া। আমি কাপুরুষ নহি যে, তোর পশ্চাৎ দিক হইতে অস্ত্র নিক্ষেপ করিব। হানিফার অস্ত্র আজ পর্যন্ত কাহারও পৃষ্ঠদেশে নিক্ষিপ্ত হয় নাই, অগ্রে চক্ষে ধাধা না লাগাইয়া অদৃশ্যভাবে কাহারও শরীরে প্রবেশ করে না। তুই মনে করি না যে, তোর পিছনে থাকিয়া আমি আঘাত করিব। তুই জঙ্গলে বাস, পাহাড়ে যাস, হানিফা তোর সঙ্গছাড়া নহে।”

 এজিদ হানিফার রক্তমাখা শরীর প্রতি একবারমাত্র দৃষ্টি করিয়াছেন। একবার মাত্র চারি চক্ষু একত্র হইয়াছে। এজিদ হানিফার দিকে দ্বিতীয় বার চাহিতে সাহসী হন নাই। কিন্তু সে রক্তজবা সদৃশ আঁখি, রক্তমাখা তরবারি তাহার চক্ষের উপর অনবরত ঘুরিতেছে, হৃদয়ে জাগিতেছে। মুহুর্তে মুহুর্ত্ত তাহার প্রাণ কাঁপিতেছে। আতঙ্কে দক্ষিণে বামে তাঁহার দেহ দুলিতেছে, কোন কোন সময়ে সম্মুখে ঝুকিতেছে। অশ্বচালনে বিশেষ পরিপক্কতা হেতুই এজিদের আসন টলিতেছে না।