পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৭
মহরম পর্ব্ব—সপ্তম প্রবাহ

কার্য্যে ভালবাসার কিছুই ত্রুটি পাইলেন না; তথাচ পূর্ব্ব ভাব, পূর্ব্ব প্রণয়, পূর্ব্ব ভালবাসার মধ্যে কি যেন একটু ছিল, তাহা নাই। সেই গৃহ, সেই স্বামী সেই হাসান, সেই জাএদা—সকলই রহিয়াছে, অথচ ইহার মধ্যে কি যেন অভাব হইয়াছে। জাএদা মনে মনে সাব্যস্ত করিলেন, এ দোষ তাঁহার নয়, এ দোষ জয়নাবের। জয়নাবকে তিনি যে, এই দোষে দোষী সাব্যস্ত করিলেন, আজও করিলেন, কালও করিলেন, জীবন-শেষ পর্য্যন্ত করিয়া রাখিলেন। দোষ ক্রমেই অন্তরে বদ্ধমূল হইয়া শত্রুভাব আসিয়া দাঁড়াইল। জয়নাব এক্ষণে তাঁহার দুই চক্ষের বিষ। জয়নাবকে দেখিলেই তাহার মনের আগুন জ্বলিয়া উঠে। হাসনেবানুর ভয়ে যে আগুন এক দিন চাপা ছিল, ক্রমে ক্রমে জয়নাবের রূপরাশির জ্যোতিঃতেজে উত্তেজিত হইয়া সেই আগুন একেবারে জ্বলিয়া উঠিল। অন্তরে আগুন, মুখেও জয়নাব-নাম শ্রবণে তিনি একেবারে আগুন হইয়া উঠিতেন। শেষে হাসনেবানু পর্য্যন্ত জানিতে পারিলেন যে, জাএদা জয়নাবের নাম শুনিলেই জ্বলিয়া উঠে। হাসনেবানু কাহাকেও কিছু বলিতেন না, কিন্তু জয়নাবকে মনে মনে ভালবাসিতেন।

 হাসান জাএদাকে পূর্ব্ব হইতেই ভালবাসিতেন, যত্নও করিতেন; এখনও পর্য্যন্ত তাহার কিছুমাত্র ব্যতিক্রম হয় নাই। তথাপি জাএদার মনে কেন উদাসভাবের উদয় হইয়াছে, তাহা তিনিই জানেন; আর কাহারও জানিবার শক্তি নাই।

 এক অন্তরে দুই মূর্ত্তি-স্থাপন হওয়া অসম্ভব। ইহার পর তিনটি যে কি প্রকারে সঙ্কুলান হইল, সমভাবে সমশ্রেণীতে স্থান পাইল, তাহা আমাদের বুদ্ধিতে আসিল না; সুতরাং পাঠকগণকে বুঝাইতে পারিলাম না। আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধির ক্ষমতা কত? অপ্রশস্ত অন্তরের আয়ত্ততাই বা কত যে, ঐ মহাপুরুষের কীর্ত্তিকলাপে বুদ্ধি চালনা করি? মনের কথা মনেই থাকিল। হাসান প্রকাশ্যে স্ত্রী-ত্রয়ের মধ্যে যে, কিছু ইতর-বিশেষ জ্ঞান করিতেন, তাহা কেহ কখনই জানিতে পারেন নাই। তিন স্ত্রীকে তিনি সমনয়নে দেখিতেন, সমভাবে ভালবাসিতেন; কিন্তু সেই সমান ভালবাসার সঙ্গে সঙ্গে হাসনেবানুকে অপেক্ষাকৃত অধিক মান্য করিতেন। জয়নাব সর্ব্বাপেক্ষা সুশ্রী; স্বভাবতঃ তিনি