পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৯
মহরম পর্ব্ব—সপ্তম প্রবাহ

কাহারও সাধ্য নাই। এক একটি স্ত্রীলোকের মনের কবাট খুলিয়া যদি চেনা যায়, তাহা হইলে অনেক বিষয় শিক্ষাও পাওয়া যায় এবং মনের অন্ধকার প্রায়ই ঘুচিয়া যায়। সে মনে না আছে এমন জিনিসই নাই; সে হৃদয়ভাণ্ডারে না আছে এমন কোন পদার্থ ই নাই। জয়নাব হাসনেবানুকে মনের সহিত ভক্তি করিতেন। জাএদাকে জ্যেষ্ঠা ভগ্নীর ন্যায় মানের সহিত স্নেহ করিতেন। কিছুদিন এই ভাবেই চলিল। কোন কালেই কোন প্রকার লোকের অভাব হয় না। এজিদের চক্রান্তে আবদুল জব্বারের দুরবস্থা হাসান পূর্ব্বেই শুনিয়াছিলেন। আবার এখন পর্য্যন্তও জয়নাবের মোহিনী মুর্ত্তি এজিদের চক্ষে সর্ব্বদা বিরাজ করিতেছে। তাঁহার বিবাহের পর এজিদের প্রতিজ্ঞা, মাবিয়ার ভর্ৎসনা, সকল কথাই মদিনায় আসিয়াছে। কোন কথা শুনিতে তাঁহার আর বাকী নাই। মাবিয়া দিন দিন ক্ষীণ ও বলহীন হইতেছেন, বাঁচিবার ভরসা অতি কম, তাহাও তিনি লোকমুখে শুনিতেছেন। এজিদের সহিত বাল্যকালে বাল্যক্রীড়ায় ঝগড়াবিবাদ হইত, এজিদ তাঁহাদের দুই ভ্রাতাকেই দেখিতে পারিত না, একথাও হাসান সময় সময় গল্পচ্ছলে জয়নাবকে শুনাইতেন। এক্ষণে জয়নাব-লাভে বঞ্চিত হইয়া শত্রুভাব সহস্রগুণে এজিদের অন্তরে দৃঢ়রূপে স্থায়ী হইয়াছে, তাহাও জয়নাবকে বলিতেন। হাসান অনেক লোকের মুখে অনেক কথা শুনিতেন; সে সকল কথায় মনোযোগ দিয়া, কি বিশ্বাস করিয়া তাহার আদি-অন্ত তন্ন তন্ন করিয়া কখনই শুনিতেন না। সাধারণের মুখে এক কথার শাখা-প্রশাখা বাহির হইয়া শতসহস্র পত্রে পরিণত হয়। সে সময় মূল কথা অণুমাত্রও বিশ্বাসের উপযুক্ত হয় না—হাসান তাহাই বিবেচনা করিয়া এক কর্ণে শুনিতেন, অন্য কর্ণে বাহির করিয়া দিতেন। ধর্ম্মোপদেশ, ধর্ম্মচর্চাই জীবনের একমাত্র কার্য্য মনে করিয়া, তিনি ঈশ্বরের উদ্দেশে জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন। যদিও মদিনার রাজা, কিন্তু রাজসিংহাসনের পারিপাট্য নাই, সৈন্য-সামন্ত ধন-জন কিছুই নাই। কিন্তু আবশ্যক হইলে ভগবৎপ্রসাদে কিছুর অভাবও নাই। মদিনাবাসীরা হাসান-হোসেন, এই দুই ভ্রাতার আজ্ঞাবহ কিঙ্কর; তাঁহাদের কার্য্যে, তাহাদের বিপদে বিনা অর্থে, বিনা স্বার্থে, বিনা লাভে জীবন দিতে প্রস্তুত।