পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৯
মহরমপর্ব্ব—নবম প্রবাহ

মস্তক হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া ধরাতলে গড়াগড়ি যাইতেছে। মোস্‌লেমের পবিত্র শোণিতবিন্দুর পরমাণু অংশে দামেস্ক-রাজভবনের পবিত্রতা, সিংহাসনের পবিত্রতা, দরবারের পবিত্রতা, ধর্ম্মাসনের পবিত্রতা, মাবিয়া যাহা বহুকষ্টে সঞ্চয় করিয়াছিলেন সেই সমস্ত পবিত্রতাআজ মোস্‌লেমের ঐ শোণিতবিন্দুর প্রতি পরমাণুতে মিশিয়া বিকট অপবিত্রতার আসন পাতিয়া দিল। মোস্‌লেমের দেহবিনির্গত রক্তধারে “এজিদ! ইহার শেষ আছে!”—এই কথা কয়টি প্রথমে অঙ্কিত হইয়া রক্তস্রোত সভাস্থলে বহিয়া চলিল। এজিদ সগর্ব্বে বলিতে লাগিলেন, “অমাত্যগণ! প্রধান প্রধান সৈনিক ও সৈন্যাধ্যক্ষগণ! এবং সভাস্থ মহোদয়গণ! আপনারা সকলেই মনোযোগপূর্ব্বক শ্রবণ করুন। আমার আজ্ঞা যে কেহ অমান্য করিবে, যে কেহ অণুমাত্র অবহেলা করিবে, সেই ব্যক্তি নিশ্চয়ই মোস্‌লেমের ন্যায় শাস্তি ভোগ করিবে। আমার অভাব নাই। হাসান-হোসেনের যাহা আছে, তাহাও কাহার অজ্ঞাত নাই। সেই হাসানের এত বড় সাহস! এত বড় স্পর্ধা! ভিখারিণীর পুত্র হইয়া রাজরাণীর পাণিগ্রহণ! যে জয়নাব রাজরাণী হইত, সে-ই ভিখারিণী-পুত্র তাহারই পাণিগ্রহণ করিয়াছে। আমি উহার বিবাহের সাধ মিটাইয়া দিব। জয়নাবকে লইয়া সুখভোগ করিবার সমুচিত প্রতিফল দিব। কে রক্ষা করিবে? কাহার আশ্রয় গ্রহণ করিবে? এজিদ জগতে থাকিতে জয়নাবকে লইয়া সে কখনই সুখী হইতে পারিবে না। এখনও আমার অন্তরে আশা আছে, যদিও সে আশায় একপ্রকার নিরাশ হইয়াছি। হাসান বাঁচিয়া থাকিতে জয়নাব-লাভ হইবার আর সম্ভাবনা নাই। তথাপি মহা-আসক্তি আগুনে এজিদের অন্তর সর্ব্বদা জ্বলিতেছে। যদি আমি মাবিয়ার পুত্র হই, তবে হাসান-হোসেনের বংশ একেবারে নিপাত না করিয়া জগৎ পরিত্যাগ করিব না। শুধু হাসানের মৃতদেহ দেখিয়াই যে, সে মহাগ্নি নির্ব্বাপিত হইবে তাহা নহে, হাসান বংশের সকলের মস্তক দ্বিখণ্ডিত করিয়াই যে এজিদ ক্ষান্ত হইবে তাহাও নহে; মোহাম্মদের বংশের একটি প্রাণীও বাঁচিয়া থাকিতে এজিদ ক্ষান্ত হইবে না; তাহার মনোবেদনাও মন হইতে বিদূরিত হইবে না। আমার অভাব কি? কাহারও সাহায্য চাহি না; হিতোপদেশ অথবা পরামর্শের প্রত্যাশা রাখি না।