পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৫
মহরম পর্ব্ব-ত্রয়োদশ প্রবাহ

আগুপিছু বিবেচনা করিয়া করিও। তোমার শত্রু অনেক, মিত্রও অনেক। মনে করিলে তুমি রাজরাণী, আবার মনে না করিলে তুমি পথের ভিখারিণী। আর বোন্! আমি ত দেখিতেছি,—বড় এমাম যে চক্ষে জয়নাবকে দেখেন, তোমাকেও সেই চক্ষে দেখিয়া থাকেন। আবার সেই চক্ষে হাস্‌নেবানুকেও দেখিয়া থাকেন। কোন বিষয়েই ত ভিন্ন ভাব দেখিতে পাই না। শুনিতে পাই, জয়নাবকেই তিনি বেশী ভালবাসেন, কিন্তু কৈ? আমি ত তাহার কিছুই দেখিতে পাই না; বরং দেখিতে পাই, তোমার প্রতি তাহার টান অধিক।”

 ঈষৎ হাস্য করিয়া জাএদা কহিলেন “তুমি কি বুঝিবে? প্রকাশ্যে কিছু ইতরবিশেষ দেখিতে পাও না, তাহা ঠিক। ভিতরে যে কি আছে, তাহা কে বুঝিবে? লোকের নিন্দা, ধর্ম্মের ভয়, কাহার না আছে? বিশেষতঃ ইহারা এমাম। প্রকাশ্যে সকল স্ত্রীকে সমান দেখেন। কিন্তু দেখাও অনেক প্রকার আছে। ধর্ম্মরক্ষা, লোকের মনে প্রবোধ, আমাদের মন বুঝান—অনায়াসেই হয়; কিন্তু উহার মধ্যে যে একটু গুহ্য ভাব আছে, তাহা আমি মুখে বলিতে পারিব না। উপমার কোন সামগ্রী সম্মুখেও নাই যে, তাহা দেখাইয়া তোমাকে বুঝাইব। এখন তিনি কথা কহেন, কিন্তু পূর্ব্বেকার সে স্বর নাই, সে মিষ্টতা নাই। ভালবাসেন, কিন্তু তাহাতে রস নাই। আদর করেন, কিন্তু সে আদরে মন গলে না; বরং বিরক্তিই জন্মে। আগে জাএদার নিকট সময়ের দীর্ঘতা আশা করিতেন; এখন যত কম হয় ততই মঙ্গল—তাহাই ইচ্ছা। পূর্ব্বে কথাবার্ত্তাতেই রাত্রি প্রভাত হইয়াছে, তবুও সে কথার ইতি হয় নাই,—মনের কথা ও ফুরায় নাই; এখন জাএদার শয্যায় শয়ন করিলে ডাকিয়া নিদ্রাভঙ্গ করিতে হয়। প্রভাতী উপাসনার সময় উত্তীর্ণ হইয়া যায়। জয়নাবের বেলা আলাদা; ঊষাকালে একত্র শয়ন করিয়া আছেন, কিন্তু উপাসনায় ব্যাঘাত নাই! ঘরের কথা, মনের কথা, কে বুঝিবে বল দেখি? আমার দুঃখ অপরে কি বুঝিবে বল দেখি? কাহাকেই বা বলিব? জগতে আমার,—আমার বলিবার কেহই নাই। মনে কোন আশাও নাই। এখন শীঘ্র শীঘ্র মরণ হইলেই আমি নিস্তার পাই!”