পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বইয়ের ব্যাবসা ধোঁয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। সে যাই হোক, আসল কথা হচ্ছে এই যে, বিজ্ঞাপনাদির স্বারা লোকের মনে শুধু কেনবার লোভ জন্মে দেওয়া যায় কিন্তু কেনানো যায় না। কোনো জিনিস কাউকে কেনাতে হলে সেটি প্রথমত তার হাতের গোড়ায় এগিয়ে দেওয়া চাই, তার পর সেটি তাকে গতিয়ে দেওয়া চাই। এ দুই বিষয়ে যে পুস্তকবিক্রেতার বিশেষ কোনো যত্ন করেছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। আমার বিশ্বাস ধ্যে, নতুন বাংলা বই যদি ঘরে-ঘরে ফেরি করে বিক্রি করা হয়, তা হলে বঙ্গসাহিত্যের প্ৰতি লক্ষ্মীর দৃষ্টি পড়বে। সাহিত্যে প্রোডাকশন সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, ডিম্যাণ্ডের প্রতি লক্ষ রেখে সাহিত্য সাপ্লাই করতে হবে। যে বই লোকে পড়তে চায় না, সে বই অপর যে-কোনো উদ্দেশ্যেই লেখা হোক-না কেন, বেচবার উদ্দেশ্যে লেখা চলে না। এবং কী ধরনের বই লোকে পড়তে চায়, সে-বিষয়ে একটা সাধারণ কথা বলা যেতে পারে। এটি একটি প্ৰত্যক্ষ সত্য যে, সাধারণ পাঠকসমাজ দুই শ্রেণীর বই পছন্দ করে না- এক হচ্ছে ভালো, আর এক হচ্ছে মন্দ। যে বই ভালোও নয় মন্দ ও নয়, অমনি একরকম মাঝামাঝিগোছের- সেই বই মানুষে পড়তে ভালোবাসে এবং সেইজন্য কেনে। প্ৰতি দেশে প্ৰতি যুগে প্ৰতি জাতির একটি বিশেষ সামাজিক বুদ্ধি থাকে। সে বুদ্ধির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে সংসারযাত্ৰানির্বাহ করা, এবং সামাজিক জীবনের কাজেতেই সে বুদ্ধির সার্থকতা। কিন্তু সচরাচর লোকে সেই বুদ্ধির মাপকাঠিতেই দর্শন বিজ্ঞান সাহিত্য আর্ট প্রভৃতি মনোজগতের পদার্থগুলোও মেপে নেয়। সে মাপে যে পদার্থটি ছোটো সাব্যস্ত হয় সেটিও যেমন গ্ৰাহ হয়না, তেমনি যেটি বড়ো সাবাস্ত হয় সেটিও গ্ৰাহ হয় না। সামাজিক বুদ্ধির সঙ্গে যদি কোনো বিশেষ বুদ্ধি খাপেখাপে না মিলে যায়, তা হলে হয় তা অতিবুদ্ধি নয় নিবুদ্ধি; এবং এই উভয় শ্রেণীর বুদ্ধির সহিত সামাজিক মানব পারতপক্ষে কোনোরূপ সম্পর্ক রাখতে চায় না। এই কারণেই সাধারণত লোকে নিবুদ্ধিতার প্রতি অবজ্ঞা এবং অতিবুদ্ধির প্রতি বিদ্বেষভাব ধারণ করে। উঁচুদরের লেখক এবং নিচুদরের লেখক সমসাময়িক পাঠকসমাজের কাছে সমান অনাদর পায়। কারণ, বুদ্ধি চরিত্র প্রভৃতি সম্বন্ধে লোকসমাজ উচুতেও উঠতে চায় না, নিচুতেও নামতে চায় না ; যেখানে আছে সেইখানেই থাকতে চায়। কেননা, ওঠা এবং নামা দুটি ক্রিয়াই বিপজ্জনক। সমাজ 'বিষয়-বালিশে আলিস’ রেখে নাটক-নভেলের দর্পণে নিজের পোশাকী চেহারা দেখতে চায়, কবির মুখে নিজের স্তুতি শুনতে ভালোবাসে, এবং যে গুরুর কাছ থেকে নিজ মতের ভ্যান্য লাভ করে তাকেই দার্শনিক বলে মান্য করে। প্ৰমাণস্বরূপ দেখানো যেতে পারে, জর্জ মেরেডিথের অপেক্ষা মেরি করেলির নভেলের হাজার গুণ কাটতি বেশি । এবং যে কবি সমাজের