পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গৌরাঙ্গ ও তঁাহার পরিকরবর্গ Sa শুধু সংস্কৃতে নহে, এতগুলি ভাষায় বুৎপত্তি থাকার দরুন তিনি জনসাধারণকে সৰ্ব্বত্র উপদেশ দিতে পারিতেন। তিনি আৰ্য্যাবৰ্ত্ত ও দাক্ষিণাত্যের বহু পণ্ডিতের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করিয়া তাহাদিগকে পরাস্ত করিয়াছিলেন । কিন্তু উত্তরকালে সহজে তিনি বিচারে প্রবৃত্ত হইতেন না। “আমি মুর্থ সন্ন্যাসী, কি বিচার করিব ?” এইরূপ পরম দৈন্যোক্তিদ্বারা বিচার-সভা এড়াইয়া যাইতেন । কিন্তু যখন তিনি “কৃষ্ণ” বলিয়া ডাকিতেন, হঠাৎ শত সহস্ৰ লোক সেই নামামৃত পান করিবার জন্য লালায়িত হইত, অসম্মাৎ যেন সেখানে পদ্মগন্ধ ছুটিত-শ্রোতৃবর্গ অসংখ্য নরনারী মুগ্ধ হইত, তাহাদের দেহ ঘন ঘন রোমাঞ্চিত ও চক্ষু সজল হইত, “পশ্চাৎ ভাগেতে মুই দেখি তাকাইয়া, শত শত নারীগণ আছে দাড়াইয়া। নারীগণ অশ্রুজিল মুছিছে আঁচলে,” এবং “অসংখ্য বৈষ্ণব শৈব সন্ন্যাসী জুটিয়া । হরিনাম শুনিতেছে নয়ন মুদিয়া।” মহারাষ্ট্র দেশে শুধু একাপ দৃশ্য সংঘটিত হয় নাই, যেখানে গিয়াছেন, সেইখানেই এইরূপ। কৃষ্ণের মোহিনী মূৰ্ত্তি দেখিয়া ভোলা মহেশ্বর অবধি যেরূপ শত শত দেবতারা অজ্ঞান হইয়া পিছনে পিছনে ছুটয়াছিলেন, পরম সুন্দরী কোন ষোড়শী রমণী রঙ্গমঞ্চে দাড়াইলে যেমন শত শত চক্ষু নিনিমেষে তাহার প্রতি আবদ্ধ হয়-চৈতন্তেব্য অশ্রশ্লাবিত দুইটি চক্ষু ও কণ্ঠস্বরের অপার্থিব মোহিনী শক্তি বৃদ্ধ অদ্বৈতাচাৰ্য্য, সার্বভৌম ও প্ৰকাশানন্দ সরস্বতী হইতে আরম্ভ কবিয়া আবালবৃদ্ধ নরনারী সকলেরই মন সেইভাবে-রূপ সাগরের পাডে টানিয়া লইয়া যাইত। এত বিদ্যাবুদ্ধি, এত পাণ্ডিত্য ও এত ভক্তি ছিল বলিয়াই তিনি যুগের প্রয়োজন সাধন করিতে পারিয়াছিলেন। সেই শুষ্ক চিন্তাশীলতাব যুগে পাণ্ডিত্য না থাকিলে কেহ আদর পাইত না। নবদ্বীপে জগাই মাধাই এব। জীবন-সংশোধন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। শুভানন্দ রায় মক জনৈক কুলীন ব্রাহ্মণ নবদ্বীপে অতিশয় ধনাঢ্য ও প্রবল হইয়া উঠিয়াছিলেন। হুসেন সাহের সঙ্গে ইহার অন্তব্য তা ছিল এবং ইনি সম্রাটের নিকট হইতে বাজা খেতাব পাইয়াছিলেন। শুভানন্দের দুই পুত্র রঘুনাথ ও জনাৰ্দন ; সুপ্ৰসিদ্ধ জগাই বা জগন্নাথ রঘুনাথের পুত্র এবং মাধব ਕaਝੇ জনাৰ্দ্দনের পুত্ৰ, এই দুই যুবক নবদ্বীপে অসুর-কল্প হইয়া দাড়াইয়াছিল। জগতে এমন কোন পাপ নাই—যাহা ইহারা না করিত। দিবারাত্ৰ মদ্যপান করিয়া বিভোর থাকিত—–“ব্ৰাহ্মণ হইয়া মদ্য গোমাংস ভক্ষণ, ডাকা চুরি গৃহদাহ করে অনুক্ষণ” (চৈ, ভা, ) : চৈতন্য ও নিত্যানন্দের উপর ইহাদের আক্রোশ ছিল, এই দিনরাত্র হরিবোলের হট্টগোল ইহাদের অসহ্য হইয়াছিল ;-ইহার একদিন দুই তরুণ সাধুকে পথে পাইয়া তাহাদের মষ্ঠের ভঁাড়টা ছুড়িয়া মারিল ; নিত্যানন্দের কপাল কাটিয়া রক্ত পড়িতে লাগিল; তথাপি প্ৰসন্নমুখে তিনি বলিলেন—“আমাকে মারিয়াছ দোষ নাই, কিন্তু একবার তোমার শ্ৰীমুখে হরিনাম কর-আমার ব্যথার জ্বালা জুড়াইবে।” এই কথার পরেও মধাই আর একবার তঁহাকে মারিতে উদ্যত হইয়াছিল, কিন্তু তরুণ সাধুদ্ধয়ের ক্ষমাশীল ভক্তিপূর্ণ মূৰ্ত্তি দেখিয়া জগাইএর নেশা ছুটিয়া গিয়াছিল, সে মাধাইকে বারণ করিল। কি মধুর কণ্ঠ-স্নেহাৰ্দ ও দয়াশীল। চৈতন্য কেবল বলিলেন,-“মাধাই, তুমি উহাকে না মারিয়া আমাকে মারিলেই জগাই ও মাধ্যাই । ”