পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গৌরাঙ্গ ও তাহার পরিকরবর্গ N কঠোর ব্ৰহ্মচৰ্য্য পালন করিয়া শুধু মেঝের পাথরের উপর শুইয়া থাকিতেন, জগদানন্দের তাহা সহ হয় নাই। সেই ভুলার বালিশ দেখিয়া চৈতন্য বলিয়াছিলেন, “জগদানন্দ, বিলাসের আর আর আসবাব বাকি রাখিলে কেন ? এখন একটা খাট লইয়া এস এবং আমাকে দিয়া বিষয় ভোগ করাইবার অন্যান্য যোগাড় কর।” আর একদিন এক ভক্ত চৈতন্যকে এক হাড়ী সুগন্ধ তৈল উপহার দিয়াছিলেন, চৈতন্য বলিলেন, “ইহা মন্দিরে লইয়া যাও এবং জগন্নাথের আরতির সময়ে জালাইও ।” এই কথায় জগদানন্দ রাগিয়া গিয়া সেই তৈলের হাড়ী ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছিলেন । পরিব্রােজ্যার নিয়ম পালন করিয়া চৈতন্য শীর্ণদেহে মাঘের নিদারুণ শৈত্য অগ্ৰাহা করিয়া শেষরাত্ৰে স্নান করিতেন। মুকুন্দের ইহা সহ্য হইত না। চৈতন্য বলিলেন, “মুকুন্দ, জগদানন্দের মত রাগ করে না; কিন্তু অতি দুঃখিত হইয়া চুপ করিয়া থাকে, তাহাতে আমার অধিকতর কষ্ট হয়।” এদিকে স্বরূপ-দামোদর চৈতন্যের উপর শিক্ষা-দণ্ড ধরিয়া ছিলেন। চৈতন্য শাস্ত্ৰ-নিয়মের ধার ধারিতেন না, উচ্ছসিত প্রেমের আবেগে কোন বিধি পালন করিতেন না। কিন্তু স্বরূপ-দামোদর “ইহা করা উচিত নহে, সন্ন্যাসীর পক্ষে উহা উচিত নহে” ইত্যাদিরূপ অনুশাসন দ্বারা তঁহাকে সৰ্ব্বদা ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিতেন। চৈতন্য দেখিলেন,-ইহারা তাহার জন্য পুনরায় মেহ ও শাসনের গৃহের মতই একটা কারাগার সৃষ্টি করিয়াছেন । পুরীর এই মেহের বন্ধনী হইতে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন। একবার ছুটিয়া পালাইবার মুখে তিনি সনাতনের বাধা পাইয়া ফিরিয়া আসিয়াছিলেন । বিবাহের বরের ন্যায় এক বিপরীত মিছিল সঙ্গে তিনি যে চলিয়াছিলেন, একথা তাহার খেয়াল ছিল না। সনাতনের উপদেশ তিনি গ্ৰহণ করিলেন। পুরীতে ফিরিয়া তথায় আর কিছুকাল থাকিয়া এবার প্রকৃতই পলাতক আসামীর ন্যায় গোপনে দাক্ষিণাত্যের দিকে যাত্রা করিলেন, সঙ্গে কালাকৃষ্ণ দাস নামক জনৈক ব্ৰাহ্মণ ছিলেন, তিনি গােদাবরীর তীর পর্য্যন্ত যাইয়া ফিরিয়া আসিলেন। একমাত্র গোবিন্দ কৰ্ম্মকার বিশ্বস্ত কুকুরের ন্যায় দীর্ঘ পথ তাহার অনুসরণ করিয়াছিলেন এবং এই ভ্ৰমণের যে সবিস্তার বৃত্তান্ত লিখিয়া গিয়াছেন তাহা দৃশ্যপটের ন্যায় সুস্পষ্ট। গোবিন্দ কৰ্ম্মকারের বাড়ী ছিল-বৰ্দ্ধমান, কাঞ্চন নগর ; র্তাহার পিতার নাম ছিল শুমাদাস এবং মাতার নাম মাধবী, গোবিন্দ তাহার স্ত্রী শশিমুখীর সহিত ঝগড়া করিয়া চিরদিনের জন্য চৈতন্যের সঙ্গী হইয়াছিলেন। সম্ভবতঃ উত্তর কালে ইনিই “শ্ৰীগোবিন্দ” নামে বৈষ্ণব সাহিত্যে সুপরিচিত হইয়াছিলেন । এই করাচা-লেখক সম্বন্ধে সমস্ত কাহিনী মৎসম্পাদিত “গোবিন্দ দাসের করাচা”র দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় দ্রষ্টব্য। ১৫১০ খৃষ্টাব্দের ৭ই বৈশাখ তিনি দক্ষিণাত্য-ভ্ৰমণে বহির্গত হন ও ১৫১১ খৃষ্টাব্দের ৩রা মাঘ পুরীতে প্ৰত্যাগত হন। সুতরাং এক বৎসর আট মাস ছাব্বিশ দিনে এই ভ্ৰমণ শেষ হয়, পুরীতে ফিরিয়া আসিয়া চৈতন্য বলদেব ভট্টাচাৰ্য্যের সঙ্গে মথুৱা, বৃন্দাবন, কাশী প্ৰভৃতি অঞ্চলে ছয় বৎসর ভ্ৰমণ করেন। তিনি অষ্টাদশ বর্ষ কাল পুরীতে ছিলেন । ১৫৩৩ খৃষ্টাব্দের আষাঢ় মাসের সপ্তমী তিথিতে রবিবার দিন বেলা ৩টার সময়ে তিনি পুরীর গুণ্ডিচা গৃহে দেহরক্ষা করেন ।