পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চৈতন্যের তিরোধান ও বৈষ্ণব সমাজ <ზ8S) হইয়াছিল। এখানে বৃদ্ধ কৃষ্ণদাস কবিবাজ তাহার আজীবন ব্ৰহ্মচৰ্যা ও অশেষ পাণ্ডিত্য ও সাধুতার অমৃতফলস্বরূপ বাঙ্গলা ভাষায় বিরচিত অপূৰ্ব্ব চৈতন্যচরিতামৃত গ্ৰন্থ লিখিয়াছিলেন ; এখানেই নরহরি চক্ৰবৰ্ত্তী তাহার অসামান্য অধ্যবসায় ও পাণ্ডিত্যের কীৰ্ত্তিস্তম্ভ ভক্তিরত্নাকর গ্ৰন্থ সঙ্কলন করেন। উত্তরকালে জীব গোস্বামী এই বৃন্দাবন কেন্দ্রের নেতা হইয়াছিলেন। এখানে রূপ, সনাতন; রঘুনাথ দাস, রঘুনাথ ভট্ট, জীব ও গোপাল ভট্ট-এই ছয়জন গোস্বামী বাস করিয়া গিয়াছেন। উত্তরকালে যে সকল বৈষ্ণবগ্ৰন্থ বাঙ্গলাদেশে লিখিত হইত, তাহা এই গোস্বামীদের নিকট প্রেরিত হইত। যে সকল গ্ৰন্থ ইহারা অনুমোদন করিতেন, তাহাই বৈষ্ণব-সমাজে প্ৰচলিত হইত। যাহাতে ইহাদের শিলমোহর থাকিত না, তাহা বৈষ্ণবসমাজে প্ৰচলিত হইতে পারিত না । ইহারা বৈষ্ণব-সমাজের বিধানকৰ্ত্তা ও নিয়ন্ত ছিলেন। বৃন্দাবন দাস। তঁহার “চৈতন্যমঙ্গল’ লিখিয়া ইহাদের অনুমোদনের জন্য বৃন্দাবনে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন, গোস্বামীরা ইহা পাঠ করিয়া অতিশয় আনন্দিত হইযাছিলেন, এবং শ্ৰীকৃষ্ণের লীলা জ্ঞাপক ভাগবতের সঙ্গে ইহাব সৌসাদৃশ্য দেখিয়া ইহার নাম “চৈতন্যভাগবত” বাখিয়াছিলেন । জীব গোস্বামী ছিলেন রূপ ও সনাতনের সহোদর অনুপমেব পুত্র। জীব অতি সুদৰ্শন ছিলেন, তঁহার পিতৃব্যের সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিয়াছেন—তঁাহারা চৈতন্যের পাগল-এই সমস্ত কথা বল্যে যখন তাহার মাতা বলিতেন, তখন বালকের গণ্ড বহিয়া অশ্রু পন্ডিত । অল্পবয়সে তিনি সর্বশাস্ত্ৰে কৃতিত্ব লাভ করেন । কিন্তু ভক্তিব আকর্ষণে তিনি একেবারে উন্মত্ত হইয়া যাইতেন । এই সংসার তাহার নিকট অল্পবয়সেই অসার বোধ হইত-পিতৃব্যদের পরিত্যক্ত অতুল ঐশ্বৰ্য্য, কৈশোবাতিক্রাস্তে র্তাহাব অতুল্য রূপ ও সুখস্বাচ্ছন্দ্য-এসকলের আকর্ষণ র্তাহার কিছুমাত্র ছিল না। যাহাকে চৈতন্য আকর্ম - করিতেন—তাহাকে কে রোধ করিবে ? একদিন ষোড়শবর্ষীয বালক জীব তঁাহাব মাতাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, সন্ন্যাসী হয় কেমন কবিয ?” মাত কঁদিতে কঁাদিতে সন্ন্যাস লওয়াৰ পদ্ধতি বলিতে লাগিলেন, কারণ—শুধু তাহার স্বামীব ভ্রাতারা নহেন, তঁহিবি স্বামীও মৃত্যুর অনতিকালীপূৰ্ব্বে সন্ন্যাসধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিয়াছিলেন। সাশ্রনেত্ৰে মাতা কিরূপে মস্তক মুণ্ডন করিতে হয়, কিৰূপে দীক্ষা লইতে হয়, কিরূপে গৈবিক বস্ত্ৰ পরিতে ও দণ্ড গ্ৰহণ করিতে হয়—এই সকল কথা বলিলেন। বালক বলিল, “আমার পিতৃব্যেরা অতুল সম্পদের অধিকারী ছিলেন, তাহাবা সন্ন্যাস লইয়া জঙ্গলের বৃক্ষপত্রে শয়ন করিয়া ও তথাকার কষায় ফল খাইয়া কিরূপে থাকেন ?” মাতা বলিলেন, “ধৰ্ম্মে বিশ্বাস ও চৈতন্যের প্রতি ভালবাসার দরুন তাহারা দৈহিক কষ্টকে কষ্টের মধ্যেই গণ্য করেন না।” পরদিন জীব দণ্ডহস্তে ও গৈরিক পরিয়া মাতার সম্মুখে আসিয়া বলিলেন, “মা, আমায় কি সন্ন্যাসীর মত দেখায় না ? এখন হইতে সকলে আমাকে প্ৰণাম করিবে- আমি একজন সাধু!” সুন্দর বালককে গৈরিক বাসে বড়ই মানাইয়াছিল। মাতা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “এমন সুন্দর চাচার কেশ মাথায় করিয়া কি কেহ সন্ন্যাসী হইতে পারে?” বালক ক্ষণকাল নিরুত্তর থাকিয়া বলিল, “আচ্ছা, কাল দেখিবো।”