পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/২৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

b8 বৃহৎ বঙ্গ বাহু তুলি, কল্পে প্রেমে ঢল ঢল। এযে হারা দেওয়ায়, মরা বাচায়, এর হুকুমে গাঙ্গ শুকালো৷” বস্তুত: সহজিয়া দলের প্রায় সমস্ত ব্যক্তিই তাহদের গুরুদের অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস করেন। আমরা তিব্বতের বৌদ্ধধৰ্ম্মপ্রসঙ্গে দীপঙ্কর শ্ৰীজ্ঞানের সময়কার নানা শ্রেণীর মত সম্বন্ধে যে সকল আলোচনা করিয়াছি, তদ্বারা স্পষ্টই দৃষ্ট হইবে।--বৌদ্ধ ধৰ্ম্মের ভাঙ্গা দল বঙ্গদেশে ছড়াইয়া পড়িয়া এই সহজিয়াদের নানাদলের সৃষ্টি করিয়াছে। ইহারা সামাজিক বা ধৰ্ম্মের চিরাগত সংস্কারের কোনটিই মানে নাই, ইহাদের চিন্তাশীলতার গতি অবাধ । ইহারা সামাজিক অনুশাসনের প্রতি ভ্ৰক্ষেপ করে নাই এবং সময়ে সময়ে এরূপ উচ্চাঙ্গের তত্ত্বকথা এত সংক্ষেপে কহিয়াছে যে, শিক্ষিত সম্প্রদায়ও সেই সকল কথা শুনিলে ভড় কাইয়া যাইতে পারেন। স্ত্রীলোকের সতীত্বসম্বন্ধে ইহারা সীতা-সাবিত্রীর আদর্শ মানে নাই। আমাদের সমাজে পতিব্ৰতার জন্য যে স্বৰ্গলোক পরিকল্পিত হইয়াছে এবং জনসাধারণ পাতিব্ৰত্যের যে উচ্চ মূল্য দিয়া থাকে, সহজিয়ারা তাহা দিতে সম্মত নহে তাহদের মতে সাধবীর তথাকথিত একনিষ্ঠ প্রেমের মধ্যে কতটা পরীকালের সুখ-কামনা ও ইহকালের লোকখ্যাতির আশা হইতে সঞ্জাত, তাহ জানিবার উপায় নাই ; হিন্দুর সংস্কার-জাত সতীত্ব এতটা মিশ্র ভাবের মধ্যে উদ্ভূত হইয়াছে, এজন্য তথাকথিত সতীত্ব বা দাম্পত্য ভাব-প্রেমের শ্ৰেষ্ঠতম আদর্শ যাচাই করিবার জন্য বিচার-সহ কষ্টিপাথর নহে। “বঙ্গসাহিত্য-পরিচয়ে”র প্ৰথম ভাগের ভূমিকায় “জ্ঞানাদি সাধন’ হইতে যে অংশ উদ্ধৃত হইয়াছে তাহাতে দেখা যায় ইহাদের ভগবান সম্বন্ধে ধারণাও একেবারেই কোন সংস্কারাধীন নহে-উহাতে চিন্তার যে সুন্ম বিশ্লেষণ-শক্তি দেখা যায় তাহা নৈয়ায়িক পণ্ডিতের মত । সমাজে জাতিভেদ প্ৰভৃতির ংস্কারের ইহার কোন ধার ধারে না । ইহারা প্ৰকাশ্যভাবে কোন ভিন্ন ধৰ্ম্মাবলম্বীকে নিজের দলে টানিয়া আনিয়া তাহার কপালে স্বীয় সম্প্রদায়ের ছাপ মারিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করে না। অথচ ইহাদের দলের লোক, খৃষ্টান হউক, মুসলমান হউক, ব্ৰাহ্মণ হউক, দলের নেতার প্রতি এতটা অনুরক্ত যে জগতে তাহাকে ছাড়া আর কাহাকেও মানে না, তাহার এক কথায় অবলীলাক্রমে প্ৰাণ দিতে পারে । কৰ্ত্তাভজাদের নেতা বাবা আউল বা আউল চাদ পরবী নামক গ্রামে ১৭৬৯ খৃষ্টাব্দে স্বৰ্গগত হন। রামশরণ এবং বাবার আর সাত শিষ্য র্তাহার দেহ পরবী গ্রামে ( চক্ৰন্দহ হইতে ছয় মাইল পশ্চিমে ) শ্মশানে ভস্মীভূত করেন। বাবা আউলের পরলোকগমনের পরে, রামর্শবণ পাল গদীর অধিকারী হইয়া নেতৃত্ব গ্ৰহণ করেন। এই দলে খৃষ্টান, মুসলমান ও হিন্দু আছে এবং যদিও নরনারীর অবাধ মিলনে কোন বাধা নাই। তথাপি ইহাদের নীতি অতি উচ্চ । ইহাদের একটি অনুশাসন এইরূপ “স্ত্রী হিজড়ে, পুরুষ খোজা, তবে হবে কৰ্ত্তা ভজা৷ ” কৰ্ত্তাভজা লাল শশীর গানগুলি ‘সন্ধ্যাভাষায়’ লিখিত, তাহা দুর্বোধি, কিন্তু কতকগুলি বোঝা যায়। সহজিয়াদের একটি গান—“তুফান আসছে কম্ভে, জলে জল যাবে মিশে, মাজি হাল ধর কম্ভে। আবার র্যাহা নৌকা, তাহা তুফান, নৌকা রাখা কি কারণ! ওরে মাজি দাডিয়ে শোন। মাজি সত্য বাদাম লও, ধীরে পীরে বাও, তুফান পানে কেন চাও, হাল ধরেছে নিরঞ্জন।” মানুষ এখানে মাঝি,-দাড় বাহিবার তাহাকে ক্ষমতা দিয়াছেন