পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ংস্কৃত প্ৰভাবান্বিত বাঙ্গলা-সাহিত্য Sb'Gł দাম্পত্য-জীবনের শুভ্ৰ সততা, অসামান্য নৈতিক বল, স্ত্রীলোক-ঘটিত ব্যাপারে সরল সতেজ সাবধানতা, অন্যায়ের প্রতি ক্ৰোধ বিশেষভাবে প্ৰকাশ পাইয়াছে। তাহার এই সকল মহাদগুণ সত্ত্বেও তাহার সাধুর ন্যায় দৈন্য এবং নিজেকে ক্ষুদ্ৰাদপি ক্ষুদ্র মনে করিয়া পরকে সন্মান করার বৃত্তি তদীয় চরিত্র মধুর করিয়া তুলিয়াছে। ফুল্লারার চরিত্র কষ্টসহিষ্ণুতা, সংযম এবং স্বামি-ভক্তির খনি ; সে স্বামীকে এত ভালবাসে যে নিদারুণ দারিদ্র্য এবং উদীপবাসাদির কষ্ট সে তিলমাত্র গণ্য করে না ; সে তাহার বারমাসীতে চণ্ডীকে যাহা যাহা বালিয়াছিল-তাহা অক্ষরে অক্ষরে সত্য-কিন্তু সেগুলিও সে দুঃসহ মনে করে নাই ; স্বামি-প্রেমে অমান মুখে সে পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ সহিয়াছে ; সেকথাগুলি বলার উদ্দেশ্য শুধু চণ্ডীকে ভয় দেখাইবার ইচ্ছ। চণ্ডীর প্রতি তাহার সন্দেহ যতই বৃদ্ধি পাইতেছে, ততই তাহার ভয়াতুর প্রাণের গভীর স্বামিভক্তি দেদীপ্যমান হইয়া উঠিতেছে। তাব।পর যখন চণ্ডী বলিলেন, “এনেছে তোমার স্বামী বাধি নিজগুণে-হয় নয় জিজ্ঞাসা করাহু বীরবরে”--তখন যেন স্বর্ণপ্ৰতিমা ভয়ে স্নান হইয়া গেল। ফুল্লরা এতক্ষণ পৰ্য্যন্ত উপদেশকের যে মুখোস পরিয়াছিল, তাহা খুলিয়া গেল এবং অসহ্য দুঃখে৷ সে কাদিয়া ফেলিল। কবিকঙ্কণ যাহা কিছু বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা স্বর্গের কথা হউক কি নরকের কথাই হউক,-সমস্তই বাঙ্গলার মাটিার । বাঙ্গলাদেশের পল্লীগুলি তঁাহার অঙ্কনকৌশলে জীবন্ত হইয়াছে। তিনি পশুপক্ষী, প্রোকৃত দৃশ্য প্রভৃতি যাহা কিছু বর্ণনা করিয়াছেনসমস্ত বিষয়ই মানব-সমাজকে প্রত্যক্ষবৎ করিয়া তুলিয়াছে। কালকেতুর সঙ্গে পশুদের যুদ্ধষোড়শ শতাব্দীতে মোগলদের সঙ্গে হিন্দুদের লড়াইয়ের একখানি চিত্ৰ। মনুষ্য-সমাজ তাহাকে এতটা পাইয়া বসিযাছিল যে, ভ্রমরগুলি ফুলে ফুলে উড়িয়া যাইতেছে একথা বলিতে যাইয়াও কবি মানুযেব সমাজই স্মরণ করিষাছেন । “এক ফুলে মকরন্দ, পান করি সদানন্দ, ধায় অলি অপর কুসুমে | এক গৃহে পেয়ে মান, গ্ৰামধ' গ্ৰী দ্বিজ যান, অন্য ঘরে আপনি সম্রামে।” ধনপতির গৃহে তৰ্কমুখর বণিক-সভা এরূপ সুচিত্রিত হইয়াছে যে তাহা দেখিলে মনে হয় আমরা বড় মানুষের বাড়ীর একটা বড় রকমের সামাজিক কোলাহলের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছি । আমরা বলিয়াছি, মুকুন্দবাম সন্ধিযুগের কবি। তাহার ভাষায় একদিকে প্রাক-সংস্কৃত যুগ, অপরদিকে সংস্কৃতাত্মক যুগ-গঙ্গাযমুনার মত—আসিয়া মিলিত হইয়াছে। “ভাঙ্গা কুঁড়ে ঘর তালপাতের ছাউনি, ভেরেণ্ডার থাম তার আছে মধ্য ঘরে” প্রভৃতি ছত্রের সঙ্গে সঙ্গে “জানুভানু কৃষাণু শীতের পবিত্ৰাণ” এক পঙক্তিতে বসিয়া গিয়াছে। ফুল্লরার বারমাসী, বণিকূদেব কলহ, মুরারি শীলের সঙ্গে কালকেতুর আলাপ প্রভৃতি আখ্যান প্রাক-সংস্কৃত যুগের ভাষার প্রকৃতি দেখাইতেছে। অপর দিকে দশভুজার বর্ণনা, খুল্লনার ছাগ লইয়া বনে বিচরণ এবং সুশীলার বারমাসী প্রভৃতি অংশ নিছক সংস্কৃত শব্দে রচিত । প্রাচীন আখ্যানের বিষয়-বস্তুটি ঠিকই আছে, কিন্তু জনাৰ্দন-ঘটকের গৌরীন্দানের মাহাত্ম্যকীৰ্ত্তন প্রভৃতি অংশে নব-ব্ৰাহ্মণ্যের প্রভাব পড়িয়াছে। এইজন্য কবিকঙ্কণকে সন্ধিযুগের কবি বলা যাইতে পারে। মুকুন্দরাম বৰ্দ্ধমান দামুন্য গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। ইহারা ব্ৰাহ্মণগণের মধ্যে কয়রি কুলের রাজা তপন ওঝা’র সন্ততি । কবির পিতার নাম হৃদয় মিশ্র, পিতামহের নাম জগন্নাথ মিশ্র,