পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sab0 বৃহৎ বঙ্গ এই নিত্য লীলার খেলোয়াড় তিনি। তিনি বৃহৎ হইতে বৃহৎ বৃহতের নিকট, কীট হইতে কীট কীটের নিকট, এই ভাবে প্ৰত্যেক জীবের দ্বারস্থ। যিনি বৃহৎ হইতেও বৃহৎ, যিনি রাজচক্ৰবৰ্ত্তীর মহোৎসবের বিধাতা, তিনি ক্ষুদ্র পিপীলিকার মিষ্টান্নকণা লইয়া ক্ষুদ্র গৰ্ত্তটির সম্মুখে দাড়াইয়া আহবান করিতেছেন। রাধিক ধৰ্ম্মকৰ্ম্ম কিছুই মানেন না, কারণ ধৰ্ম্মকৰ্ম্মের মালিককে পাইয়াছেন, “কি আর শুনাও ধরম করম-মন স্বতন্ত্রর নয়”-“মরম না জানে, ধরম বখানে, এমন আছয়ে যারা, কাজ নাই সখি তাদের কথায়, বাহিরে রাহুন তারা ।” “আমি কানু অনুরাগে এ দেহ সঁপেছি, তিল তুলসী দিয়া”—তিল-তুলসী দিয়া যে দান হয়, তাহা আর ফিরাইয়া আনা যায় না। কে এরূপ আছেন, যিনি বলিতে পারেন-ভগবানকে তিনি কিছুমাত্র না। রাখিয়া দেহ দান করিয়াছেন ? তাহার চক্ষু, কৰ্ণ, নাসিকা, জিহবা, ত্বকসমস্তই ভগবানের অধীন, তঁহারই প্ৰীত্যর্থে তাহারা চালিত, তাহদের অন্য কোন কাজ নাই। রাধিক যাহা দিয়াছেন।--তাহা চেষ্টা করিয়াও ফিরাইয়া আনিবার সাধ্য নাই। “কত নিবারিয়ে তায় নিবার না যায়রে । আনপথে যাই, পদ কানু পথে ধায়রে ৷ এ ছার নাসিক মুই কত করি বন্ধ ; তবুতো দারুণ নাসা পায় তার গন্ধ।” প্রেমিক হিসাবে চণ্ডীদাস অদ্বিতীয়, কবি-শিল্পী হিসাবেও তিনি অদ্বিতীয় । তাহার উৎকৃষ্ট কবিতাগুলির মধ্যে পাঠক বা শ্রোতার কল্পনা উদ্বোধন করিবার অবকাশ আছে, তিনি সমস্ত কথা খুলিয়া বলেন নাই, দুর্লভ ভাবগুলির ইঙ্গিত দিয়া গিয়াছেন। যেদিন ভগবানের প্ৰতি ভালবাসা জন্মে, সেদিন সেই পুলিকের তরঙ্গ সর্বত্র বহিয়া যায়-সেই ভাবাবিষ্ট হইয়া মানুষ আত্মহারা হইয়া যায় ; “গুরুজন আগে দাড়াইতে নারি, সদা ছল ছল আঁখি । পুলকে আকুল, দিক্‌ নেহারিতে- সব শ্যামময় দেখি ” যমুনায় যাওয়ার সময়ে সে কি ভাব । তখন তিনি সকল কথা খুলিয়া বলিতে পারেন না।-“সখীর সহিতে, জলেরে যাইতে-সেকথা কহিবার নয়।” যমুনাষ যাওয়ার সময়ে তাহার যে অবস্থা হয়-তােহা বলিতে যাইঘা মুখের কথা ফিরিয়া দাড়ায় । সে অপ্ৰকাশ্য অসহ্যু আনন্দের কথা মনে হইতেই তিনি আবিষ্ট হইয়া পড়েন। “যমুনার জল, করে ঝলমল, তাহে কি পরাণ রায় ?” কেন যমুনার জল ঝলমল করে-তােহা আর তিনি বলিতে পারেন নাই— “সেকথা কহিবার নয়।” কৃষ্ণ কদম ডালে বসিয়া থাকেন, র্তাহারই মযুৱ-পক্ষাসংযুক্ত উজ্জল মূৰ্ত্তির প্রতিবিম্ব জলের উপর পাড়িয়া ঝলমল করে--রাধা এত কথা বলিতে পারেন নাই, পরবত্তী এক কবি বলিয়াছেন- “ঢেউ দিও না কেউ জলে, বলে কিশোরী। দরশনে দাগ দিলে হবে পাতকী ।” রাধা লোকনিন্দা সহিতেছেন।--তাহার জাতি-কুল-শাল ছাড়া প্ৰেম, জগ-ভরা নিন্দ, তিনি কলঙ্কা, কিন্তু তাহাতে ভ্ৰক্ষেপ নাই—তাহা শতবার বলিয়াছেন ; “দেখিলে কলঙ্কীর মুখ কলঙ্ক হইবে—এজনার মুখ আর দেখিতে না হবে।” উপবাস, লোকনিন্দা, গুরুজনের গঞ্জন, এসমস্তই তিনি প্ৰফুল্লমুখে সহিয়াছেন “যথা তথা নাই আমি, যতদূর চাই। চাদ মুখের মধুর হাসে তিলেকে জুড়াই।” এমন অমৃত থাকিতে সংসারের বিষ আর র্তাহার কি করিবে ?