পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চৈতন্য-যুগ ܗܶܘܶܘܶ বন্যা আনয়ন করিয়াছিল । “গলার কবচ মোর, শিঙ্গাদার ধর ধর, দিও মোর যেখানে জননী। নিশান অঙ্গুরী লয়ে, ময়ুরার হাতে দিয়ে, ক’য়ো তুমি হ’লে অনাথিনী, শুকার সুবৰ্ণ ছড়া, বাপেরও ঢাল খাড়া, সব দিয়া সমাচার ব’লো। রণে অকাতর হ’য়ে, শক্রশির ংহারিয়ে, সন্মুখসমরে শাক মলো” (ধৰ্ম্মমঙ্গল) মৃত্যুকালে মহাবীর শাকার এই উক্তির সঙ্গে মাথুরের “ললিতা লহ কঙ্কণ, বিশাখা লহ অঙ্গুরী, চিত্ৰ লহ নীলমণি চুড়ি” ইত্যাদি পদ মিলাইয়া পড়ুন ; বাঙ্গালীর রণক্ষেত্র ও কামকুঞ্জ একযুগে একই বিয়োগান্ত দৃশ্যের অবতারণা করিয়াছিল--এই জন্য বঙ্গ-সাহিত্যময় সর্বত্র একই সুরের সাড়া পাইতেছি। জয়দেবের কবিতা ঘরে ঘরে আনন্দময়ের যে আনন্দ-লীলার বার্তা ঘোষণা করিয়াছিল, সেই বাৰ্ত্তার উপসংহার পরবর্তী মাথুর গীতে। বিজয়সেনের প্রদ্যুমেশ্বরের মন্দিরের নিকটবৰ্ত্তী প্ৰমোদ-উদ্যানে অভিসারিকাগণ মুখর নূপুর ত্যাগ করিয়া নীলাম্বরী ও মেঘাডুঘুর শাড়ী আঁধার রাত্রির সঙ্গে মিশাইয়া দিয়া “ৰ্বাধি তাম্বল আঁচলে”-যে লীলা করিয়াছিলেন, জয়দেবের চক্ষে ছিল সেই দৃশ্য, কিন্তু পরবর্তী কবিগণের শ্রেষ্ঠ নায়িকাব নিরাভরণা যোগিনীর বেশ-তিনি উপবাস-ক্লিষ্ট, গেরুয়া-পরিহিতা-“বিরতি আহারে-রাঙ্গ বাসা পরে - যেমন যোগিনী পারা।” কৃষ্ণবিরহে তিনি সৰ্ব্বস্বত্যাগিনী—“শঙ্খ করাহ চুর, ভূষণ করাহ দূর, তোড়হি গাজমোতি হাররে”—“সীথাক সিন্দুর-—মুছিয়া করাহ দূর।” এই সৰ্ব্বত্যাগিনীর নিরাভরণ রূপ তখন বঙ্গের আকাশে বাতাসে খেলিতেছিল। তখন উৎকৃষ্ট কষ্টিপ্রস্তব-নিৰ্ম্মিত চন্দনচর্চিত নীলকলেবর অতুলনীয় শ্যামরূপ, বিধৰ্ম্মাদের হাতের নিৰ্ম্মম আঘাতে চুর্ণ-বিচূর্ণ ;-তখন ভক্ত সাশ্রচক্ষু উদ্ধে তুলিয়া নব-মেঘে, স্বীয় বিপুল কুন্তলরাশিতে এবং ময়ুর-ময়ূরীর কণ্ঠে সেই কালো রূপ আবিষ্কার পূর্বক ধ্যানস্থ হুইলৈন—তখন “আকুল নয়নে চাহে মেঘ পানে কি কহে দুহাত তুলে, এলাইয়া বেণী ফুলের গ৷ খুনী দেখয়ে খসায় চুলে।” এবং “এক দিঠি করি, ময়ুর ময়ুরী কণ্ঠ করে নিরক্ষণে।” শ্ৰীমন্দির ও শ্ৰীবিগ্ৰহধ্বংসের পর বৈষ্ণব কবি-মাথুরালীলার সঙ্গে সঙ্গে ব্রজলীলার সম্পূর্ণ পার্থক্য ধারণা করিতে পারিলেন । ভাবতের অন্য কোন জাতি জড় ও অধ্যাত্মরাজ্যের পার্থক্য এতটা বুঝিতে পারে নাই। হীরামণির ভাণ্ডার ও মথুরার অতুল ঐশ্বৰ্য্যকে দূরে ফেলিয়া কাঙ্গাল ভক্ত ব্রজের একটু ধূলিকণার প্রার্থী হইলেন ; মথুরার সমস্ত শক্তি অপেক্ষা যে প্রেমের শক্তি সহস্ৰগুণে বড়-মাথুরে তাহাই প্ৰতিপন্ন হইল। এইভাবে বাঙ্গালী জড়-সম্পদের বিয়োগে অধ্যাত্ম-রাজ্যের প্রজা হইলেন ও ভক্তির সুক্ষ্ম-তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছিলেন। প্ৰাচীন যুগের শেষ অধ্যায় বহু সংস্কৃত গন্থের বঙ্গানুবাদে বাঙ্গলার শব্দ-সম্পদ ক্রমশঃ বাড়িয়া উঠিল। কাশীরাম দাসের মহাভারতে এই সম্পদ বিশেষরূপে পরিদৃষ্ট হয়, কিন্তু মুসলমান কবি আমালোশিয়াল সংস্কৃতে যে পাণ্ডিত্য দেখাইয়াছেন, পরবত্তী কবি ভারতচন্দ্র ভিন্ন এতটা পাণ্ডিত্য আর কেহ দেখান