পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৪৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SS De বৃহৎ বঙ্গ ভারতবর্ষের এই ভৌগোলিক বিবরণ সংস্কৃতে প্ৰণয়ন করেন। এই বিবরণ হইতে জানা যায় যে মেদিনীপুর জেলার কতকটা ‘ভান দেশ” নামে পরিচিত ছিল। মহাভারতে তাম্রলিপ্তের উল্লেখ আছে। এই নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে একটা মত উল্লেখ-যোগ্য। পূর্বে এই তাম্রলিপ্তের আর একটি নাম ছিল “দামলিপ্ত”। দামল জাতীয় লোকের নিবাসবশতঃ ঐ নাম হইয়াছে এবং এই “দামল” জাতিই ক্ৰমে দক্ষিণদেশে যাইয়া “তামিল” নামে পবিচিত হইয়াছে। তাহা হইলে মেদিনীপুর জেলার আদিম লোকেরাই তামিল দেশের প্রতিষ্ঠাতা। তমলুকের আরও অনেক গৌরবের কথা আছে। মহাভারতের আদিপর্বে, সভাপর্বে, দ্রোণপর্বে এবং ভীষ্মপর্বে তাম্রলিপ্তের যেরূপ উল্লেখ দৃষ্ট হয়, তাহাতে অনুমান করা যায় যে এককালে তাম্রলিপ্ত একটি স্বতন্ত্র এবং বৃহৎ রাজ্য ছিল। জৈমিনীয় ভারতে তাম্রধ্বজেব ( ময়ূরধ্বজের পুত্ৰ ) সঙ্গে অৰ্জ্জুনের যে যুদ্ধ-বৃত্তান্ত বাণিত আছে, অনেকে মনে কবেন। উক্ত বাজাদের তাম্রলিপ্তই রাজধানী ছিল। মহাভারতের পরবর্তী সময়ে আমরা জৈন ও বৌদ্ধ গ্রন্থে তাম্রলিপ্তের বহু উল্লেখ দেখিতে পাই । জৈন গুরু ভদ্রবাহুর ( চন্দ্রগুপ্তের দীক্ষাগুরু ) প্ৰধান শিষ্য গোদাস জৈনদিগের চারটি সম্প্রদায্যের সৃষ্টি কবেন, তন্মধ্যে “তামলিপ্তিকা” অন্যতম । খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে গ্ৰীক লেখক রচিত “ Periplus of the Try thraean * (ইংরেজী নাম ) পুস্তকে তামলিপ্ত যে ভারতীয় প্রধান বন্দরগুলির একটি, তাহা উল্লিখিত আছে। উত্তর-ভারত "হইতে ভারতসাগরের দ্বীপগুলিতে যাতায়াত তামলিপ্ত বন্দর দ্বারা সম্পাদিত হইত। এই বন্দরের চারিদিকে বৌদ্ধ সঙ্ঘারাম ও স্কুপের ভগ্নাবশেষ দৃষ্ট হয়, এমন কি প্রমাণিত হইয়াছে যে বর্গভীমাব মন্দির একটি প্রাচীন বৌদ্ধস্তুপের উপর নিৰ্ম্মিত। মেগেস্থেনিস সম্ভবতঃ এই তাম্রলিপ্তবাসী দিগকেই “তালুক্ত” নামে উল্লেখ করিয়াছেন এবং গ্রীক লেখক প্লিনিও খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে সেই কথার পুনরাবৃত্তি করিয়াছেন । “তালুক্ত” জাতি অতি পরাক্রান্ত বলিয়া বাণিত হইয়াছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্ৰে তাম্রলিপ্তের উল্লেখ আছে। চন্দ্ৰগুপ্ত কিংবা তৎপুত্র বিন্দুসার কেহই তাম্রলিপ্ত রাজ্য অধিকার করিতে পারেন নাই। অশোক যে যুদ্ধে অসংখ্য লোক বিনষ্ট করিয়া কলিঙ্গ অধিকার করিয়াছিলেন-সেই কলিঙ্গের সৈন্তাগণ বোধ হয় তাম্রলিপ্তবাসীরাই ছিলেন, ইহারাই তখন অত্যন্ত দুর্দান্ত ছিলেন। হিউনসাঙ্গ তাম্রলিপ্ত নগরে অশোকের অনুশাসন-স্তম্ভ দেখিয়াছিলেন । সম্ভবতঃ অশোকের অনুশোচনী দুর্দান্ত কলিঙ্গবাসী দিগকে কতকটা নিরস্ত করিয়াছিল । এই তাম্রলিপ্তের জাহাজে অশোকের কনিষ্ঠ ভ্রাতা মহেন্দ্র ও সহোদরা সঙ্ঘমিত্ৰা (মতান্তরে পুত্র ও কন্যা) সিংহলে গিয়াছিলেন । চীন পরিব্রাজক ফাহায়েন (৪১১-৪১২ খৃঃ) দুই বৎসর তাম্রলিপ্তে বাস করিয়া তথা হইতে অর্ণবযানে সিংহলে যাত্ৰা করেন। তিনি এই স্থানে ২৪টি সজঘারাম দেখিয়াছিলেন । সপ্তম শতাব্দীদে হিউনসাঙ্গ তাম্রলিপ্তে ১০টি বৌদ্ধমঠ ও সহস্রাধিক শ্রমণ দেখিয়াছিলেন । ৬৩৫ খৃঃ অব্দে তাম্রলিপ্ত একবার সমুদ্র-ধৌত হইয়াছিল। হিউনসাঙ্গের পর ৬৭৩ খৃঃ অব্দে ইচিং নামক চৈনিক পরিব্রাজক কাংচাউ নগর হইতে সমুদ্রযানে তাম্রলিপ্ত নগরে আগমন করিয়াছিলেন ।