সহায়তা করিয়াছেন, তাহা ভাবিলেও আশ্চর্য্য হইতে হয়। তিনি পরিষৎ হইতে ছুটি লইয়া রাত্রি দশটা এগারটা পর্য্যন্ত আমার ওখানে কাজ করিয়াছেন। প্রাকৃত ভাষায়, উড়িয়া, হিন্দী, আসামী প্রভৃতি ভাষায় তাঁহার যে ব্যুৎপত্তি আছে, তাহাতেও আমার বিশেষ উপকার হইয়াছে।
যে সকল পুস্তক প্রকাশ করিতেছি, তাহার মধ্যে চর্য্যাচর্য্য ও ডাকার্ণব নেপাল দরবারের। সে পুথি ছাপা হইবার পর তাঁহারা লইয়া গিয়াছেন। আমি তাঁহাদের অনুমতি লইয়া পুথির অনেকগুলি পাতা ফটোগ্রাফ করিয়া রাখিয়াছি এবং আমার পুস্তকের সঙ্গে প্রকাশ করিতেছি। অপর দুইখানি পুথি আমার নিজের অথবা নিজের হইতেও অধিক প্রিয়; কারণ, নেপালের পুথিখানার সুব্বা সাহেব বিষ্ণুপ্রসাদ রাজভাণ্ডারী আমাকে প্রীতি-উপহারস্বরূপ ঐ দুইখানি প্রদান করিয়াছিলেন। তাঁহার পূর্ব্বপুরুষেরা চব্বিশ পুরুষ ধরিয়া নেপালের মল্লরাজাদের প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। তাঁহার প্রপিতামহ শেষ নেওয়ার রাজার সহিত কাশীবাস করিয়াছিলেন এবং পরে গোর্খা পর্ব্বতে প্রাণত্যাগ করেন। তাঁহার পিতা জঙ্গ বাহাদুরের সহিত এক পাঠশালায় পড়িয়াছিলেন, কিন্তু জঙ্গ বাহাদুর যখন ১৮৪৬ সালে কোতের হত্যাকাণ্ডের পর গোর্খারাজের সহিত বন্দোবস্ত করিলেন,—“রাজ তুম্হারি, হুকুম হমারী,” তখন তিনি গোর্খারাজ্যে তাঁহার যে উচ্চ পদ ছিল, তাহা ত্যাগ করিয়া ঘরে গিয়া বসিলেন। জঙ্গ বাহাদুর তাঁহাকে পুনর্ব্বার পদ গ্রহণ করাইবার জন্য অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু তিনি কিছুতেই লইলেন না; বলিলেন,—“আমি নেওয়ারদের নুন খাইয়া গোর্খাদের সঙ্গে মিলিয়াছিলাম, যথেষ্ট পাপ হইয়াছে। এথন আবার গোর্খাদের নুন খাইয়া তোমার সহিত মিশিব না।” জঙ্গ বাহাদুর তাঁহার পুত্রকে উচ্চ রাজপদ দিতে চাহিলে বিষ্ণুপ্রসাদ বলিলেন,—“যাহাতে অস্ত্র ধারণ করিতে হয়, এমন পদ আমি লইব না।” তাই তাঁহাকে পুথিখানার অধ্যক্ষ করা হয়। তিনি পুথিখানায় বসিয়া ক্রমাগত তন্ত্রের বহি পড়িতেন এবং তন্ত্রের অনেক খবর রাখিতেন। নেপালে যেখানে যে পুথি আছে, তাহা তাঁহার নখদর্পণে ছিল। তিনি একদিন কয়েকখানি প্রাচীন তালপাতার পুথি লইয়া আমার বাসায় আসিয়া বলিলেন, “তুমি ব্রাহ্মণ, আমার দেশে আসিয়াছ ও পুথি খুঁজিতেছ। তোমায় কি উপহার দিব, অনেক দিন ভাবিয়া ভাবিয়া এই পুস্তক কয়খানি আনিয়াছি। আমি জানি, তুমি ইহার সদ্ব্যবহার করিবে।” আমি দেখিলাম, তাহার মধ্যে সরোরুহ বজ্রের দোঁহাকোষ ও তাহার অদ্বয়বজ্রের টীকা আছে। আমি অত্যন্ত আনন্দিত হইয়া তাঁহাকে শত শত ধন্যবাদ দিয়া বলিলাম, আপনার নিকট হইতে আমি আমার দেশের ইতিহাসের একটা প্রধান সরঞ্জাম পাইলাম,—আমি নিশ্চয় এটি ছাপাইব। ছাপাইয়া আমি যদি তাঁহাকে ইহার এক কপি দিতে পারিতাম, তাহা হইলে আমার আনন্দের সীমা থাকিত না। কিন্তু ঠিক দুই বৎসর হইল, তিনি ইহলোক পরিত্যাগ করিয়াছেন।