পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট
১৪৯

আর কিছু বলিলেন না, কেবল জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিভা?” যেন তাঁহার মনে একটি অতিক্ষীণ আশা জাগিয়াছিল যে, সীতারাম যাহা বলিয়াছিল, তাহা সত্য না হইতেও পারে। সমস্তটা স্পষ্ট জিজ্ঞাসা করিতে ভয় হইতেছে পাছে বিভা তাহার উত্তর দিয়া ফেলে! তাঁহার ইচ্ছা নয় যে বিভা তৎক্ষণাৎ তাঁহার এ প্রশ্নের উত্তর দেয়। তাই তিনি অতি ভয়ে ভয়ে বিভার মুখখানিকে জিজ্ঞাসা করিলেন—“বিভা?” তাই তিনি অতি একাগ্র দৃষ্টে তাহার মুখের দিকে একবার চাহিলেন। বিভা বুঝিল এবং বিভা উত্তর দিতেও পারিল না। তাহার প্রথম আনন্দ-উচ্ছ্বাস ফুরাইয়া গেছে। আগে যখন দাদা মহাশয় আসিতেন, সেই সব দিন তাহার মনে পড়িয়াছে! সে এক কি উৎসবের দিনই গিয়াছে! তিনি আসিলে কি একটা আনন্দই পড়িত! হাসিয়া তামাসা করিত, বিভা হাসিত কিন্তু তামাসা করিতে পারিত না, দাদা প্রশান্ত আনন্দ মূর্ত্তিতে দাদা মহাশয়ের গান শুনিতেন; আজ দাদা মহাশয় আসিলেন, কিন্তু আর কেহ তাঁহার কাছে আসিল না, কেবল এই আঁধার সংসারে একলা বিভা— সুখের সংসারের একমাত্র ভগ্নাবশেষের মত এক্‌লা—দাদা মহাশয়ের কাছে দাঁড়াইয়া আছে। দাদা মহাশয় আসিলে যে ঘরে আনন্দ-ধ্বনি উঠিত—সেই সুরমার ঘর আজ এমন কেন; সে আজ স্তব্ধ, অন্ধকার, শূন্যময়— দাদা মহাশয়কে দেখিলেই সে ঘরটা যেন এখনি কাঁদিয়া উঠিবে! বসন্তরায় একবার কি যেন কিসের আশ্বাসে সেই ঘরের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন— দরজার কাছে দাঁড়াইয়া ঘরের মধ্যে মাথা লইয়া একবার চারিদিক দেখিলেন, তৎক্ষণাৎ মুখ ফিরাইয়া বুকফাটা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন— “দিদি, ঘরে কি কেহই নাই?”

 বিভা কাঁদিয়া উঠিয়া কহিল, “না দাদা মহাশয়, কেহই না।”

 স্তব্ধ ঘরটা যেন হা-হা করিয়া বলিয়া উঠিল—“আগে যাহারা ছিল তাহারা কেহই নাই!”,