পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট
১৭৯

 প্রাসাদের বহির্দ্বারে যাইতেই একজন প্রহরী কহিল, “মহারাজ আপনার সঙ্গে যাইব?”

 যুবরাজ কহিলেন—“না আবশ্যক নাই।”

 প্রহরী কহিল—“মহারাজের হাতে অস্ত্র নাই!”

 যুবরাজ কহিলেন—“অস্ত্রের প্রয়োজন কি?”

 উদয়াদিত্য প্রাসাদের বাহিরে গেলেন। একটি দীর্ঘ বিস্তৃত মাঠ আছে, সেই মাঠের মধ্যে গিয়া পড়িলেন। এক্‌লা বেড়াইতে লাগিলেন। ক্রমে, দিনের আলো মিলাইয়া আসিতে লাগিল। মনে কত কি ভাবনা উঠিল। যুবরাজ তাঁহার এই লক্ষ্যহীন উদ্দেশ্যহীন জীবনের কথা ভাবিতে লাগিলেন। ভাবিয়া দেখিলেন, তাঁহার কিছুই স্থির নাই, কোথাও স্থিতি নাই—পরের মুহূর্ত্তেই কি হইবে তাহার ঠিকানা নাই। বয়স অল্প, এখনো জীবনের অনেক অবশিষ্ট আছে—কোথাও ঘর বাড়ি বাঁধিয়া কোথাও স্থায়ী আশ্রয় না পাইয়া এই সুদুর-বিস্তৃত ভবিষ্যৎ এমন করিয়া কিরূপে কাটিবে? তাহার পর মনে পড়িল—বিভা। বিভা এখন কোথায় আছে? এত কাল আমিই তাহার সুখের সূর্য্য আড়াল করিয়া বসিয়াছিলাম—এখন কি সে সুখী হইয়াছে? বিভাকে মনে মনে কত আশীর্ব্বাদ করিলেন।

 মাঠের মধ্যে রৌদ্রে রাখালদের বসিবার নিমিত্ত অশথ, বট, খেজুর, সুপারি প্রভৃতির এক বন আছে—যুবরাজ তাহার মধ্যে গিয়া প্রবেশ করিলেন। তখন সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে। অন্ধকার করিয়াছে। যুবরাজের আজ পালাইবার কথা ছিল—সেই সংকল্প লইয়া তিনি মনে মনে আন্দোলন করিতেছিলেন। বসন্তরায় যখন শুনিবেন, উদয়াদিত্য পালাইয়া গেছেন, তখন তাঁহার কিরূপ অবস্থা হইবে—তখন তিনি হৃদয়ে আঘাত পাইয়া করুণ মুখে কেমন করিয়া বলিবেন—“অ্যাঁ। দাদা, আমার কাছ হইতে পালাইয়া গেল!” সে ছবি তিনি যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন।—