পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
অক্ষয়কুমার দত্ত
অক্ষয়কুমার দত্ত

সম্পাদনা করিয়াছিলেন। তাঁহার পরিচালননৈপুণ্যে ও রচনাগুণে এই পত্রিকা অনতিবিলম্বে তৎকালীন বঙ্গদেশের শ্রেষ্ঠ সাময়িকপত্রে পরিণত হয়। তত্ত্ববিদ্যা ব্যতীত সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, পুরাতত্ত্ব, ইতিহাস, ভূগােল প্রভৃতি। বিষয়েও উৎকৃষ্ট প্রবন্ধাবলী ইহাতে স্থান পাইত এবং কোনও কোনও প্রবন্ধ সচিত্রও হইত। অক্ষয়কুমারের নিজের সুপরিচিত উৎকৃষ্ট রচনার অধিকাংশই ইহাতে প্রথম প্রকাশিত হয়। কিন্তু অক্ষয়কুমার কেবলমাত্র তত্ত্ববােধিনী পত্রিকার বেতনভােগী সম্পাদকই ছিলেন না, তিনি মনে প্রাণে ব্রাহ্মসমাজ ও তত্ত্ববােধিনী সভার আদর্শকে গ্রহণ করিয়াছিলেন। ১৮৪৩ খ্ৰী ২১ ডিসেম্বর (৭ পৌষ ১৭৬৫ শক) তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অপর উনিশজন বন্ধুর সহিত পণ্ডিত রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের নিকট ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মসমাজে এই প্রথম দীক্ষিত ব্রাহ্মসম্প্রদায়ের পত্তন হইল। অক্ষয়কুমারের মনে সর্বদা বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ প্রবল ছিল। তখন পর্যন্ত ব্রাহ্মসমাজ বেদের অভ্রান্ততায় বিশ্বাস পরিত্যাগ করেন নাই। ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে এই প্রকার অন্ধ শাস্ত্রবিশ্বাসের বিরুদ্ধে যাহারা প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন অক্ষয়কুমার তাহাদিগের নেতৃস্থানীয় ছিলেন। মুখ্যতঃ ইহাদের সহিত সমস্যাটির আলােচনা করিয়াই দেবেন্দ্রনাথের মনেও এই বিষয়ে সন্দেহ জাগে এবং বহু চিন্তা ও অনুশীলনের পর অবশেষে সর্বসম্মতিক্রমে ব্রাহ্মসমাজ অভ্রান্ত শাস্ত্রে বিশ্বাস পরিত্যাগ করেন। অতঃপর ‘আত্মপ্রত্যয়সিদ্ধ জ্ঞানােজ্জলিত বিশুদ্ধ হৃদয়’ ব্রাহ্মধর্মের ভিত্তিভূমি বলিয়া স্থির হইল। ব্রাহ্মসমাজের ধর্মমতের বিবর্তনে এই বৃহৎ পরিবর্তনটির সহিত অক্ষয়কুমারের নাম জড়িত হইয়া আছে। অক্ষয়কুমার সর্ববিধ সমাজসংস্কারের উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। ১৮৫৪ খ্র ১৫ ডিসেম্বর কাশীপুরে কিশােরীচাঁদ মিত্রের ভবনে মুখ্যতঃ কুসংস্কার-উচ্ছেদ ও সমাজকল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে, কিশােরীচাঁদ মিত্র, প্যারীচাঁদ মিত্র, হরিশ্চন্দ্র মুখােপাধ্যায়, চন্দ্রশেখর দেব, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রাধানাথ শিকদার প্রভৃতির উদ্যোগে সমাজোন্নতিবিধায়িনী সুহৃৎসমিতি’ নামক যে প্রতিষ্ঠান গঠিত হইয়াছিল, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অক্ষয়কুমার দত্ত যথাক্রমে তাহার সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হইয়াছিলেন। স্ত্রীশিক্ষার প্রবর্তন, হিন্দুবিধবার পুনর্বিবাহপ্রচলন, বাল্যবিবাহবর্জন ও বহুবিবাহনিরােধ এই সভার কার্যতালিকাভুক্ত ছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ-আন্দোলনও অক্ষয়কুমার মনেপ্রাণে সমর্থন করিয়া তত্ত্ববােধিনী পত্রিকার পৃষ্ঠায় এই আন্দোলনের সপক্ষে লেখনী চালনা করেন।

খ্ৰীষ্টীয় ধর্মযাজকগণ কর্তৃক বলপূর্বক হিন্দুদিগকে খ্ৰীষ্টধর্মে দীক্ষাদানের বিরুদ্ধে দেবেন্দ্রনাথ যখন সমগ্র শিক্ষিত হিন্দুসমাজকে সংঘবদ্ধ করিবার জন্য উদ্যোগী হন, তখন সেই কার্যেও তিনি অক্ষয়কুমারকে সহযােগী রূপে পাইয়াছিলেন। ‘তত্ত্ববােধিনী পত্রিকার পৃষ্ঠায় নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও জমিদারগণের নিষ্ঠুর প্রজাপীড়নের বিরুদ্ধেও অক্ষয়কুমার লেখনীচালনা করেন। ১৮৫৫ খ্ৰী ১৭ জুলাই কলিকাতায় নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হইলে, প্রতিষ্ঠাতা বিদ্যাসাগরের অনুরােধে তিনি মাসিক ১৫০ টাকা বেতনে প্রধান শিক্ষকের কার্যভার গ্রহণ করেন। কিন্তু শিয়ােরােগের প্রাবল্যে ১৮৫৮ খ্রী, আগস্ট মাসে তাহাকে এই পদ পরিত্যাগ করিতে হয়। সেই সময় প্রধানতঃ বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় তত্ত্ববােধিনী সভা হইতে তাঁহাকে মাসিক ২৫, টাকা বৃত্তিদানের ব্যবস্থা হয়। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই। | তাহার পুস্তকের আয় বৃদ্ধি পাওয়াতে তিনি উক্ত বৃত্তি পরিত্যাগ করেন। রামমােহনের মৃত্যুর পর যখন দেবেন্দ্রনাথ কর্তৃক ব্রাহ্ম| সমাজ নৃতনভাবে সংগঠিত হইল তখন ব্রাহ্মসমাজের চিন্তাধারায় প্রধানতঃ দুইটি বৈশিষ্ট্য দেখা দিয়াছিল। ইহার একটি ভক্তিবাদ, অপরটি যুক্তিবাদ। রামমােহনের চিন্তাধারার মধ্যে এই দুই ধারার সুন্দর সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়, বৈদান্তিক ব্রহ্মজ্ঞানের সহিত তিনি পাশ্চাত্ত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানকে | সার্থকভাবে মিলাইতে পারিয়াছিলেন। পরবর্তী কালের ব্রাহ্মসমাজের নেতৃবৃন্দের চিন্তাধারায় ব্যক্তিগত প্রকৃতি অনুসারে কখনও বা প্রথমটি কখনও বা দ্বিতীয়টির উপর | ঝোঁক পড়িয়াছে। অক্ষয়কুমার তাহার জীবনে, চিন্তায়

ও রচনায় মুখ্যতঃ রামমােহনের জীবনদর্শনের এই যুক্তিবাদী দিকটিকেই ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। এই ক্ষেত্রে তিনি প্রধান হইলেও একক ছিলেন না। তাহাদের একটি দল ছিল। ভক্তিবাদী দেবেন্দ্রনাথের সহিত তাহাদের সময়ে সময়ে মতবিরােধও হইত, যদিও এই মতভেদ তাহাদের মধ্যে কখনও বিচ্ছেদ ঘটায় নাই। অভ্রান্ত শাস্ত্রে বিশ্বাসবর্জন সর্ববিধ সামাজিক কুপ্রথার উচ্ছেদ ও সমাজকল্যাণ -মূলক ব্যবস্থার প্রচলন প্রভৃতি বিষয়ে অক্ষয়কুমার প্রমুখ যুক্তিবাদী ব্ৰাহ্মদিগের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। এইস্থলে উল্লেখ যােগ্য, ব্রাহ্মসমাজে সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষায় ঈশ্বরােপাসনা প্রবর্তনের অক্ষয়কুমার অন্যতম সমর্থক ছিলেন। ব্রাহ্ম হইলেও তিনি প্রার্থনার আবশ্যকতা স্বীকার করিতেন না। শেষ জীবনে তিনি অনেকটা অজ্ঞাবাদী (agnostic) হইয়া উঠেন। পাশ্চাত্ত্য যুক্তিবাদী দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক গ্রন্থের আদর্শে বাংলা