পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

________________

অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ দিয়া থাকেন। উপলব্ধির পার্থক্য অনুসারে এই অদ্বয়জ্ঞানতত্ত্বেরই ব্ৰহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবান্ এই তিন নাম হইয়া থাকে (ভাগবত ১।২।১১)। বেদান্তীগণ অদ্বয়জ্ঞানতত্ত্বকে ব্রহ্ম আখ্যা দিয়া থাকেন, যােগীগণ এই তত্ত্বকে পরমাত্মা বলিয়া থাকেন এবং ভক্তগণ এই তত্ত্বকে। ভগবান্ নামে অভিহিত করিয়া থাকেন। ছান্দোগ্যশ্রুতির অনুসরণ করিয়া আচার্য শংকরও বলিয়াছেন যে ব্ৰহ্ম এক অদ্বিতীয় তত্ত্ব, অর্থাৎ অদ্বয় জ্ঞানতত্ত্ব। তঁাহার মতে ব্রহ্ম এক অদ্বিতীয় তত্ত্ব বলিয়াই তাহাতে স্বজাতীয়, বিজাতীয়, এমন কি স্বগত ভেদও থাকিতে পারে না। এক জাতীয় বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে যে পার্থক্য দেখা যায় তাহার নাম স্বজাতীয় ভেদ। একটি অশ্বের সহিত অপর একটি অশ্বের প্রভেদ স্বজাতীয় ভেদের দৃষ্টান্ত। ব্রহ্মের স্বজাতীয় আর কেহ নাই ; সুতরাং তাহার স্বজাতীয় ভেদ নাই। এক জাতীয় পদার্থের সহিত ভিন্ন জাতীয় পদার্থের প্রভেদকে বিজাতীয় ভেদ বলা হয়। চেতন পদার্থের সহিত অচেতন পদার্থের প্রভেদ বিজাতীয় ভেদের দৃষ্টান্ত। জ্ঞানস্বরূপ ব্ৰহ্ম ব্যতীত যখন আর কিছুই নাই। তখন তাহার বিজাতীয় ভেদের প্রশ্নই উঠিতে পারে না। কোনও জীবদেহের সহিত উহার অবয়বসমূহের প্রভেদকে স্বগত ভেদ বলা হয়। বৃক্ষের দেহের মধ্যে মূল, কাণ্ড, শাখা প্রভৃতির ভেদবৈচিত্রী আছে বলিয়া বৃক্ষের সহিত উহার মূলকাণ্ডাদির স্বগত ভেদ স্বীকার করা হয়। কিন্তু ব্রহ্মের স্বগত ভেদ স্বীকার করা যায় না। কারণ। ব্রহ্মের স্বরূপের মধ্যে কোনও বৈচিত্র্য নাই; ব্ৰহ্ম নির্বিশেষ চৈতন্যস্বরূপ। ব্রহ্মের শক্তি বা গুণ স্বীকার করিলে ব্রহ্মের সহিত উক্ত শক্তি বা গুণের ভেদও স্বীকার করিতে হইবে। ভেদ স্বীকার করিলে অদ্বয়ত্বের হানি হইবে, এই ভয়ে শংকর ব্রহ্মকে নিঃশক্তিক ও নিগুণ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। তিনি ব্রহ্মের সর্বশক্তিমত্তা ও সর্বজ্ঞাদিজ্ঞাপক শ্ৰতিসমূহের পারমার্থিক মূল্য স্বীকার করেন নাই। তাহার মতে শুধু উপাসনার সুবিধার জন্যই শ্রুতিতে ব্রহ্মের সবিশেষত্বাদির কথা বলা হইয়াছে। সর্ববিধ ভেদরহিত, নিগুণ, নির্বিশেষ ব্ৰহ্মই একমাত্র সত্য। ভগবৎস্বরূপসমূহ মায়াপ্রসূত। শংকরাচার্য শ্ৰতিবাক্যের অন্তর্গত অনেক শব্দের মুখ্যা বৃত্তি পরিত্যাগ করিয়া লক্ষণ। ও গােণী বৃত্তির আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন। তত্ত্বমসি’ শ্রুতির ব্যাখ্যায় শংকর যাহা বলিয়াছেন তাহার সারাংশ এইরূপ- ‘তৎ’ শব্দের অর্থ সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান চিরূপ ব্ৰহ্ম এবং ‘বং’ পদের অর্থ অল্পজ্ঞ, অল্পশক্তিমান চিরূপ জীব। ব্রহ্মের সর্বজ্ঞাদি এবং জীবের অল্পজ্ঞদি বৈশিষ্ট্য________________

অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ বাদ দিলে সহজেই বুঝা যায় যে, জীব ও ব্ৰহ্ম অভিন্ন, কারণ উভয়েই চৈতন্যস্বরূপ। | বঙ্গীয় বৈষ্ণবাচার্যগণ বলেন যে, মুখ্যার্থের সংগতি থাকিলে লক্ষণ বৃত্তিদ্বারা কোনও শব্দের অর্থ করা উচিত নহে। বেদবাক্যের অর্থ মুখ্যা বৃত্তিতেই করা উচিত। তাহা করিলে বেদের স্বতঃপ্রামাণ্য স্বীকার করার সার্থকতা থাকে না। লক্ষণদ্বারা নির্ণীত অর্থ স্বতঃপ্রমাণ নহে, যেহেতু যুক্তির সহায়তা ব্যতীত সেই অর্থ লাভ করা যায় । কি অভেদবাচক, কি ভেদবাচক, কি নির্বিশেষ ব্ৰহ্মবােধক, কি সবিশেষ ব্ৰহ্মবােধক সকল শ্রতিবাক্যেরই গুরুত্ব সমান। দৃশ্যমান জীব-জগদাদির সত্যতা স্বীকার করিয়াও ব্রহ্মের অদ্বয়ত্ব রক্ষা করা সম্ভব। জীবের ও জগতের পৃথক অস্তিত্ব থাকিলেও উহার। ব্ৰহ্মনিরপেক্ষ নহে। আপাত দৃষ্টিতে ব্রহ্মের সহিত উহাদের ভেদ প্রতীয়মান | হইলেও তত্ত্বতঃ উহারা ব্রহ্মের সহিত অভিন্ন। ব্রহ্মের সহিত অপর কোনও পদার্থের ভেদ স্থাপন করা সম্ভব নহে। দুইটি পদার্থের প্রত্যেকটিই যদি স্বয়ংসিদ্ধ হয় তাহা | হইলে তাহাদের ভেদ সিদ্ধ হয়। স্বয়ংসিদ্ধ, স্বজাতীয় বা বিজাতীয় কিংবা স্বগত কোনও ভেদ ব্রহ্মের নাই। সুতরাং ব্রহ্মের অদ্বয়ত্বের হানি ঘটিবার সম্ভাবনা নাই। ব্ৰহ্ম এবং জীব উভয়েই চিংপদার্থ ; তথাপি জীবে ব্রহ্মের স্বজাতীয় ভেদ আছে বলা চলে না, যেহেতু জীব স্বয়ংসিদ্ধ পদার্থ নহে; জীব ব্রহ্মেরই তটস্থ শক্তি, ব্রহ্মাপেক্ষ। ব্রহ্মের সহিত মায়ার এবং মায়াপ্রসূত জগতের পার্থক্য সুস্পষ্ট। ব্ৰহ্ম চিং, ইহারা জড় ; তথাপি ইহাদের মধ্যে ব্রহ্মের বিজাতীয় ভেদ আছে বলা চলে না, যেহেতু মায়া ব্রহ্মেরই শক্তি এবং জগৎ ব্রহ্মেরই সৃষ্টি। ইহারা স্বয়ংসিদ্ধ বস্তু নহে, ইহারাও ব্রহ্মাপেক্ষ। ব্রহ্মে স্বগত ভেদও নাই। স্বগত ভেদের অর্থ উপাদানগত ভেদ এবং তজ্জনিত ক্রিয়াশক্তির ভেদ। জীবের মধ্যে স্বগত ভেদ আছে, কারণ জীবের উপাদানগত দেহ এবং দেহী এক বস্তু নহে। দেহ জড়, দেহী চিরূপ। ব্রহ্মের মধ্যে এইরূপ দেহ-দেহী ভেদ নাই। ব্ৰহ্মকে সচ্চিদানন্দবিগ্রহ বলা হইয়া থাকে। ইহার অর্থ— যেই ব্ৰহ্ম, সেই বিগ্রহ ; যেই বিগ্রহ, সেই ব্ৰহ্ম। ব্রহ্মে উপাদানগত ভেদ না থাকায় তজ্জনিত | ক্রিয়াশক্তি ভেদও নাই, জীবের মধ্যে উপাদানগত ভেদ| জনিত ক্রিয়াশক্তি ভেদ আছে। জীবের চক্ষু-কৰ্ণাদি | তাহার দেহের পৃথক পৃথক উপাদান। চক্ষুতে তেজের

ভাগ বেশি বলিয়া চক্ষু কেবল দেখিতে পারে, শুনিতে পারে | না ; কর্ণে মরুতের ভাগ বেশি বলিয়া কর্ণ শুনিতে পারে, দেখিতে পারে না। কিন্তু ব্ৰহ্মে উপাদানগত ভেদ না

২০