পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আদিপর্ব
৮১

কিন্তু না পেরে হাঁটু গেড়ে ব’সে পড়লেন। মহাবীর জরাসন্ধেরও ওই অবস্থা হ’ল, তিনি উঠে নিজ রাজ্যে চ’লে গেলেন। মদ্ররাজ শল্যও অক্ষম হয়ে ভূপতিত হলেন। তখন ব্রাহ্মণদের মধ্য থেকে অর্জুন উঠে দাঁড়ালেন। কেউ তাঁকে বারণ করলেন, কেউ বললেন, শল্য প্রভৃতি মহাবীর অস্ত্রজ্ঞ ক্ষত্রিয়রা যা পারলেন না একজন দুর্বল ব্রাহ্মণ তা কি ক’রে পারবে। ব্রাহ্মণেরা বললেন, আমরা হাস্যাম্পদ হ’তে চাই না, রাজাদের বিদ্বেষের পাত্র হ’তেও চাই না। আর একজন বললেন, এই শ্রীমান যুবার গতি সিংহের তুল্য, বিক্রম নাগেন্দ্রের তুল্য, বোধ হচ্ছে এ কৃতকার্য হবে। ব্রাহ্মণের অসাধ্য কিছু নেই, তাঁরা কেবল জল বা বায়ু বা ফল আহার ক’রেও শক্তিমান।

 ধনুর কাছে গিয়ে অর্জুন কিছুক্ষণ পর্বতের ন্যায় অচল হয়ে রইলেন, তার পর ধনু প্রদক্ষিণ ক’রে বরদাতা মহাদেবকে প্রণাম এবং কৃষ্ণকে স্মরণ ক’রে ধনু তুলে নিলেন। তার পর তাতে অনায়াসে গুণ পরিয়ে পাঁচটি শর সন্ধান ক’রে যন্ত্রের ছিদ্রের মধ্য দিয়ে লক্ষ্যভেদ করলেন। লক্ষ্য বিদ্ধ হয়ে ভূপতিত হ’ল। অন্তরীক্ষে ও সভামধ্যে তুমুল কোলাহল উঠল, দেবতারা অর্জুনের মস্তকে পুষ্পবৃষ্টি করলেন, সহস্র সহস্র ব্রাহ্মণ তাঁদের উত্তরীয় নাড়তে লাগলেন, রাজারা লজ্জিত হয়ে হায় হায় বলতে লাগলেন, বাদ্যকারগণ তূর্যধ্বনি করলে, সূতমাগধগণ স্তুতিপাঠ করতে লাগল। দ্রুপদ অতিশয় আনন্দিত হলেন। সভায় কোলাহল বাড়তে লাগল, নকুল-সহদেবকে সঙ্গে নিয়ে যুধিষ্ঠির তাঁদের বাসভবনে চ’লে গেলেন।

বিদ্ধন্তু লক্ষ্যং প্রসমীক্ষ্য কৃষ্ণা
পার্থঞ্চ শক্রপ্রতিমং নিরীক্ষ্য।
স্বভ্যস্তরূপাপি নবের নিত্যং
বিনাপি হাসং হসতীব কন্যা॥
মদাদৃতেঽপি স্থলতীব ভাবৈ-
র্বাচা বিনা ব্যাহরতীব দৃষ্ট্যা।

—লক্ষ্য বিদ্ধ হয়েছে দেখে এবং ইন্দুতুল্য পার্থকে নিরীক্ষণ ক’রে কুমারী কৃষ্ণা হাস্য না ক’রেও যেন হাসতে লাগলেন। বহুবার দৃষ্ট হ’লেও তাঁর রূপ দর্শকদের কাছে নূতন বোধ হ’ল। বিনা মত্ততায় তিনি যেন ভাবাবেশে স্খলিত হ’তে লাগলেন, বিনা বাক্যে যেন দৃষ্টি দ্বারাই বলতে লাগলেন।

 দ্রৌপদী স্মিতমুখে নিঃশঙ্কচিত্তে সেই সভাস্থিত নৃপতি ও ব্রাহ্মণগণের সমক্ষে অর্জুনের বক্ষে শুক্ল বরমাল্য লম্বিত করলেন। তার পর দ্বিজগণের প্রশংসাবাক্য শুনতে শুনতে অর্জুন দ্রৌপদীকে নিয়ে সভা থেকে নির্গত হলেন।