পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৷৷৵৹
মহাভারত

ক্রোধ ছিল না, কিন্তু দ্রুপদ প্রতিশোধের জন্য উদ্‌যোগী হলেন। উদার স্বভাব দ্রোণ তা জেনেও দুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডীকে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রযদ্ধে দ্রোণের হস্তেই দ্রুপদের মৃত্যু হ’ল, ধৃষ্টদ্যুম্নও পিতৃহন্তার শিরশ্ছেদ করলেন। কৌরবপক্ষে থাকলেও দ্রোণ অর্জুনের প্রতি তাঁর পক্ষপাত গোপন করেন নি, এজন্য তাঁকে দুর্যোধনের বহু কটূ বাক্য শুনতে হয়েছে।

 ধৃতরাষ্ট্র অব্যবস্থিতচিত্ত, তাঁর নীচতা আছে উদারতাও আছে, দূর্যোধন তাঁকে সম্মোহিত ক’রে রেখেছিলেন। দ্যূতসভায় বিদূর ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন, ‘মহারাজ, দুর্যোধনের জয়ে আপনার খুব আনন্দ হচ্ছে, কিন্তু এ থেকেই যদ্ধ আর লোকক্ষয় হবে। ধনের প্রতি আপনার আকর্ষণ আছে এবং তার জন্য আপনি মন্ত্রণা করেছেন তা আমি জানি।’ এই অস্থিরমতি হতভাগ্য অন্ধ বৃদ্ধের ধর্মবুদ্ধি মাঝে মাঝে জেগে ওঠে, তখন তিনি দুর্যোধনকে ধমক দেন। সংকটে পড়লে তিনি বিদুরের কাছে মন্ত্রণা চান, কিন্তু স্বার্থত্যাগ করতে হবে শুনলেই চ’টে ওঠেন। ধৃতরাষ্ট্রের আন্তরিক ইচ্ছা যুদ্ধ না হয় এবং দুর্যোধন যা অন্যায় উপায়ে দখল করেছেন তা বজায় থাকে। কৃষ্ণ যখন পাণ্ডবদূত হয়ে হস্তিনাপুরে আসেন তখন ধৃতরাষ্ট্র তাঁকে ঘুষ দিয়ে বশে আনবার ইচ্ছা করেছিলেন। দারুণ শোক পেয়ে শেষ দশায় তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত হ’ল, যধিষ্ঠিরকে তিনি পুত্রতুল্য জ্ঞান করলেন। আশ্রমবাসিকপর্বে বনগমনের পূর্বে প্রজাদের নিকট বিদায় নেবার সময় ধৃতরাষ্ট্র যা বলেছেন তা সদাশয়তার পরিচায়ক।

 গান্ধারী মনস্বিনী, তিনি পত্রের দুর্বৃত্ততা ও স্বামীর দুর্বলতা দেখে শঙ্কিত হন, ভর্ৎসনাও করেন, কিন্তু প্রতিকার করতে পারেন না। শতপুত্রের মৃত্যুর পর কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠিরের উপর তাঁর অতি স্বাভাবিক বিদ্বেষ হয়েছিল, কিন্তু তা দীর্ঘকাল রইল না। পরিশেষে তিনিও পাণ্ডবগণকে পুত্রতুল্য জ্ঞান করলেন।

 কুন্তী দৃঢ়চরিত্রা তেজস্বিনী বীরনারী, দ্রৌপদীর যোগ্য শাশুড়ী। তিনি যখনই মনে করেছেন যে পুত্রেরা নিরুদ্যম হয়ে আছে তখনই অনতিতীক্ষ্ণ বাক্যে তাঁদের উৎসাহিত করেছেন। উদ্‌যোগপর্বে কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন, “পুত্র, তুমি মন্দমতি, শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণের ন্যায় কেবল শাস্ত্র আলোচনা ক’রে তোমার বুদ্ধি বিকৃত হয়েছে, তুমি কেবল ধর্মেরই চিন্তা করেছ।”

 যুধিষ্ঠির অর্জুনের তুল্য কীর্তিমান নন, কিন্তু তিনিই মহাভারতের নায়ক ও কেন্দ্রস্থ পুরুষ। তাঁকে নির্বোধ বললে অবিচার হবে, কিন্তু দ্যূতপ্রিয়তা উদারতা ও ধর্মভীরুতার জন্য সময়ে সময়ে তিনি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সাধারণত তাঁর ক্রোধ অল্প সেজন্য প্রতিশোধের প্রবৃত্তি তীক্ষ্ণ নয়; কিন্তু কদাচিৎ তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন, যেমন কর্ণপর্বে অর্জুনের উপর। তিনি বিশেষ যুদ্ধপটু নন, সেজন্য তাঁর ভ্রাতারা তাঁকে একটু আড়ালে রাখেন, তথাপি মাঝে মাঝে তিনি বীরত্ব দেখিয়েছেন। দ্রোণবধের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণের প্ররোচনায় নিতান্ত অনিচ্ছায় তিনি মিথ্যা