পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আদিপর্ব
৮৫

হলেন, ঐশ্বর্য দেখে তাঁরা বিস্ময় প্রকাশ করলেন না। পরিষ্কৃত-বেশধারী দাসদাসী ও পাচকগণ, স্বর্ণ ও রৌপ্যের পাত্রে অন্ন পরিবেশন করলে, পাণ্ডবগণ যথেচ্ছা ভোজন ক’রে তৃপ্ত হলেন। তার পর তাঁরা অন্যান্য উপহার সামগ্রী অগ্রাহ্য ক’রে যেখানে যুদ্ধোপকরণ ছিল সেখানে গেলেন। তা লক্ষ্য ক’রে দ্রুপদ রাজা, তাঁর পুত্র ও মন্ত্রিগণ নিঃসন্দেহ হলেন যে এঁরা কুন্তীপুত্র।

 যুধিষ্ঠির নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললেন, মহারাজ, নিশ্চিন্ত হ’ন, আমরা ক্ষত্রিয়, পদ্মিনী যেমন এক হ্রদ থেকে অন্য হ্রদে যায় আপনার কন্যাও তেমন এক রাজগৃহ থেকে অন্য রাজগৃহে গেছেন। দ্রুপদ বললেন, আজ পুণ্যদিন, অর্জুন আজই যথাবিধি আমার কন্যার পাণিগ্রহণ করুন। যুধিষ্ঠির বললেন, মহারাজ, আমারও বিবাহ করতে হবে। দ্রুপদ বললেন, তবে আমার কন্যাকে তুমিই নাও, অথবা অন্য কাকে উপযুক্ত মনে কর তা বল। তখন যুধিষ্ঠির বললেন, দ্রৌপদী আমাদের সকলের মহিষী হবেন এই কথা আমার মাতা বলেছেন। আমাদের এই নিয়ম আছে, রত্ন পেলে একসঙ্গে ভোগ করব, এই নিয়ম ভঙ্গ করতে পারি না। দ্রুপদ বললেন, কুরুনন্দন, এক পুরুষের বহু স্ত্রী হতে পারে, কিন্তু এক স্ত্রীর বহু পতি শোনা যায় না। তুমি ধর্মজ্ঞ ও পবিত্রস্বভাব, এমন বেদবিরুদ্ধ লোকবিরুদ্ধ কার্যে তোমার মতি হ’ল কেন? যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, ধর্ম অতি সূক্ষ্ম, তার গতি আমরা বুঝি না, প্রাচীনদের পথই আমরা অনুসরণ করি। আমি অসত্য বলি না, আমার মনও অধর্মে বিমুখ, আমার মাতা যা বলেছেন তাই আমার অভিপ্রেত।

 দ্রুপদ, যুধিষ্ঠির, কুন্তী, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি সকলে মিলে বিবাহ সম্বন্ধে বিতর্ক করতে লাগলেন, এমন সময় ব্যাস সেখানে উপস্থিত হলেন। সকল বৃত্তান্ত তাঁকে জানিয়ে দ্রুপদ বললেন, আমার মতে এক স্ত্রীর বহু পতি হওয়া লোকবিরুদ্ধ বেদবিরুদ্ধ। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, সদাচারী জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কি ক’রে কনিষ্ঠ ভ্রাতার ভার্যায় উপগত হবেন? যুধিষ্ঠির বললেন, পুরাণে শুনেছি গৌতমবংশীয়া জটিলা সাতজন ঋষির পত্নী ছিলেন; মুনিকন্যা বার্ক্ষীর দশ পতি ছিল, তাঁদের সকলেরই নাম প্রচেতা। মাতা সকল গুরুর শ্রেষ্ঠ, তিনি যখন বলেছেন—তোমরা সকলে মিলে ভোগ কর, তখন তাঁর আজ্ঞা পালন করাই ধর্ম। কুন্তী বললেন, যুধিষ্ঠিরের কথা সত্য, আমি মিথ্যাকে অত্যন্ত ভয় করি, কি করে মিথ্যা থেকে মুক্তি পাব? ব্যাস বললেন, ভদ্রে, তুমি মিথ্যা থেকে মুক্তি পাবে। পাঞ্চালরাজ, যুধিষ্ঠির যা বলেছেন তাই সনাতন ধর্ম, যদিও সকলের পক্ষে নয়। এই ব’লে ব্যাস দ্রুপদের হাত ধ’রে অন্য এক গৃহে গেলেন।