পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
৷৷৶৹

বলেছেন, কিন্তু সাধারণত পাপপুণ্যের সূক্ষ্ম বিচার না করে তিনি কোনও কর্ম করেন না, এজন্য দ্রৌপদী আর ভীমের কাছে তাঁকে বহু ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে। যুধিষ্ঠিরের অহংবুদ্ধি বড় বেশী, তার ফলে কেবলই নিজেকে পাপী মনে করে মনস্তাপ ভোগ করেন। বার বার তাঁর মুখে বৈরাগ্যের কথা শুনে ব্যাসদেবও বিরক্ত হয়ে তাঁকে ভর্ৎসনা করেছেন। যুধিষ্ঠির ভালমানুষ হ’লেও দৃঢ়চিত্ত, যা সংকল্প করেন তা থেকে টলেন না। অবস্থাবিশেষে তিনি realist ও হ’তে পারেন। কপট উপায়ে দ্রোণবধের জন্য অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে তিরস্কার করেছিলেন, কিন্তু যুধিষ্ঠির বিশেষ অনুতপ্ত হন নি। অশ্বত্থামা যখন নারায়ণাস্ত্রে পাণ্ডবসৈন্য বধ করছিলেন তখন অর্জুনকে নিশ্চেষ্ট দেখে যুধিষ্ঠির দ্রোণের অন্যায় কার্যাবলীর উল্লেখ ক’রে ব্যঙ্গ ক’রে বললেন, ‘আমাদের সেই পরম সুহৃৎ নিহত হয়েছেন, অতএব আমরাও সবান্ধবে প্রাণত্যাগ করব।’ ভীম নাভির নিম্নে গদাপ্রহার ক’রে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করলেন দেখে বলরাম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ভর্ৎসনা ক’রে চ’লে গেলেন। তখন যুধিষ্ঠির বিষণ্ণ হয়ে কৃষ্ণকে বললেন, 'ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা আমাদের উপর বহু অত্যাচার করেছে, সেই দারুণ দুঃখ ভীমের হৃদয়ে রয়েছে, এই চিন্তা ক’রে আমি ভীমের আচরণ উপেক্ষা করলাম।’ যুধিষ্ঠিরের মহত্ত্ব সব চেয়ে প্রকাশ পেয়েছে শেষ পর্বে। তিনি স্বর্গে এলে ইন্দ্র তাঁকে ছলক্রমে নরকদর্শন করতে পাঠালেন। যুধিষ্ঠির মনে করলেন তাঁর ভ্রাতারা ও দ্রৌপদী সেখানেই যন্ত্রণাভোগ করছেন। তখন তিনি স্বর্গের প্রলোভন ও দেবতাদের অনুরোধ পরম অবজ্ঞায় উপেক্ষা ক’রে বললেন, ‘আমি ফিরে যাব না, এখানেই থাকব।’

 ভীমকে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, ‘রক্তপ রাক্ষস।’ যুধিষ্ঠিরের মুখে অশ্বত্থামার মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ শুনে দ্রোণ যখন অবসন্ন হয়েছেন তখন ভীম নির্মম ভাষায় দ্রোণকে তিরস্কার করলেন। ভীম কর্তৃক দুঃশাসনের রক্তপানের বিবরণ ভীষণ ও বীভৎস। তথাপি সাধারণ লোকে এই স্থূলবুদ্ধি হঠকারী প্রতিহিংসাপরারণ নির্দয় লোকটিকে স্নেহ করে। ভীম তাঁর বৈমাত্র ভ্রাতা হনুমানের মত আরাধ্য হ’তে না পারলেও জনপ্রিয় হয়েছেন, কারণ তিনি উৎকট অপরাধের উৎকট শাস্তি দিতে পারেন। সেকালের যাত্রার ভীম, যিনি ‘দাদা আর গদা’ ভিন্ন কিছুই জানতেন না, যখন অয়েলক্লথের গদা নিয়ে আসরে নামতেন তখন আবালবৃদ্ধবনিতা উৎফুল্ল হ’ত। ভীম চমৎকার কুযুক্তি দিতে পারেন। বনবাসে তের মাস যেতে না যেতে অধীর হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘কৃষক যেমন অল্প পরিমাণ বীজের পরিবর্তে বহু শস্য পায়, বুদ্ধিমান সেইরূপ অল্প ধর্ম বিসর্জন দিয়ে বৃহৎ ধর্ম লাভ করেন। ... সোমলতার প্রতিনিধি যেমন পূতিকা, সেইরূপ বৎসরের প্রতিনিধি মাস। আপনি তের মাসকেই তের বৎসর গণ্য করুন। যদি এইরূপ গণনা অন্যায় মনে করেন তবে একটা সাধুস্বভাব ষণ্ডকে প্রচুর আহার দিয়ে তৃপ্ত করুন, তাতেই পাপমুক্ত হবেন। ভীম মাংসলোভী পেটুক ছিলেন এবং তাঁর গোঁফদাড়ির অভাব ছিল; কর্ণ তাঁকে ঔদরিক