পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৸৹
মহাভারত

আর তূবরক (মাকুন্দ) ব’লে খেপাতেন। শান্তিপর্বে যুধিষ্ঠির বলেছেন, ‘ভীম, অজ্ঞ লোকে উদরের জন্যই প্রাণিহিংসা করে, অতএব সেই উদরকে জয় কর, অল্পাহারে জঠরাগ্নি প্রশমিত কর।’ ধৃতরাষ্ট্রাদির অপরাধ ভীম কখনই ভুলতে পারেন নি, যুধিষ্ঠিরের আশ্রিত পুত্রহীন জ্যেষ্ঠতাতকে কিঞ্চিৎ অর্থ দিতেও তিনি আপত্তি করেছেন। তাঁর গঞ্জনা সইতে না পেরেই ধৃতরাষ্ট্র বনে যেতে বাধ্য হলেন।

 অর্জুন সর্বগুণান্বিত এবং মহাভারতের বীরগণের মধ্যে অগ্রগণ্য। তিনি কৃষ্ণের সখা ও মন্ত্রশিষ্য, প্রদ্যুম্ন ও সাত্যকির অস্ত্রশিক্ষক, নানা বিদ্যায় বিশারদ এবং অতিশয় রূপবান। মহাকাব্যের নায়কোচিত সমস্ত লক্ষণ তাঁর আছে, এই কারণে এবং অত্যধিক প্রশস্তির ফলে তিনি কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছেন। অর্জুন ধীরপ্রকৃতি, কিন্তু মাঝে মাঝে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। কর্ণপর্বে যুধিষ্ঠির তাঁকে তিরস্কার করে বলেছিলেন, ‘তোমার গাণ্ডীব ধনু অন্যকে দাও।’ তাতে অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে কাটতে গেলেন, অবশেষে কৃষ্ণ তাঁকে শান্ত করলেন। কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের পূর্বক্ষণে কৃষ্ণ অর্জুনকে যে গীতার উপদেশ শুনিয়েছিলেন তা পেয়ে জগতের লোক ধন্য হয়েছে। অর্জুনের ‘ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্য’ দূর হয়েছিল, কিন্তু কোনও স্থায়ী উপকার হয়েছিল কিনা সন্দেহ। আশ্বমেধিকপর্বে অর্জুন কৃষ্ণের কাছে স্বীকার করেছেন যে বুদ্ধির দোষে তিনি পূর্বের উপদেশ ভুলে গেছেন।

 নকুল-সহদেবের চরিত্রে অসামান্যতা বেশী কিছু পাওয়া যায় না। উদ্‌যোগপর্বে কৃষ্ণ যখন পাণ্ডবদূত হয়ে হস্তিনাপুরে যাচ্ছিলেন তখন নকুল তাঁকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা কালোচিত মনে কর তাই করবে।’ কিন্তু সহদেব বললেন, ‘যাতে যুদ্ধ হয় তুমি তাই করবে, কৌরবরা শান্তি চাইলেও তুমি যুদ্ধ ঘটাবে।’ মহাপ্রস্থানিকপর্বে যুধিষ্ঠির বলেছেন, ‘সহদেব মনে করতেন তাঁর চেয়ে বিজ্ঞ কেউ নেই। নকুল মনে করতেন তাঁর চেয়ে রূপবান কেউ নেই।’

 মহাভারতে সকল পাণ্ডবেরই দ্রৌপদী ভিন্ন অন্য পত্নীর উল্লেখ পাওয়া যায়, কিন্তু ভীমের পত্নী হিড়িম্বা এবং অর্জুনের পত্নী উলূপী চিত্রাঙ্গদা ও সুভদ্রা ছাড়া আর সকলের স্থান আখ্যানমধ্যে নগণ্য।

 দ্রৌপদী সীতা-সাবিত্রীর শ্রেণীতে স্থান পান নি, তিনি নিত্যস্মরণীয়া পঞ্চকন্যার একজন। দ্রৌপদী সর্ব বিষয়ে অসামান্যা, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে অন্য কোনও নারী তাঁর তুল্য জীবত রূপে চিত্রিত হন নি। তিনি অতি রূপবতী, কিন্তু শ্যামাঙ্গী সেজন্য তাঁর নাম কৃষ্ণা। বার বৎসর বনবাস প্রায় শেষ হয়ে এলে সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ তাঁকে হরণ করতে আসেন। তখন বয়সের হিসাবে দ্রৌপদী যৌবনের শেষ প্রান্তে এসেছেন, তিনি পঞ্চ বীর পুত্রের জননী, তারা দ্বারকায় অস্ত্রশিক্ষা করছে। তথাপি জয়দ্রথ তাঁকে দেখে বলছেন, ‘এঁকে পেলে আমার আর বিবাহের প্রয়োজন নেই, এই নারীকে দেখে মনে হচ্ছে অন্য নারীরা বানরী।’ দ্রৌপদী যখন বিরাটভবনে সৈরিন্ধ্রী রূপে এলেন তখন রাজমহিষী সুদেষ্ণা তাঁকে দেখে বললেন, ‘তোমার