পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
৸৴৹

করতল পদতল ও ওষ্ঠ রক্তবর্ণ, তুমি হংসগদ্‌গদভাষিণী, সুকেশী, সুস্তনী,···কাশ্মীরী তুরঙ্গমীর ন্যায় সদর্শনা। ···রাজা যদি তোমার উপর লুব্ধ না হন তবে তোমাকে মাথায় ক’রে রাখব। এই রাজভবনে যেসকল নারী আছে তারা একদৃষ্টিতে তোমাকে দেখছে, পুরুষেরা মোহিত হবে না কেন?···সুন্দরী, তোমার অলৌকিক রূপ দেখে বিরাট রাজা আমাকে ত্যাগ ক’রে সর্বান্তঃকরণে তোমাতেই আসক্ত হবেন।’ এই আশঙ্কাতেই সুদেষ্ণা দ্রৌপদীকে কীচকের কবলে ফেলতে সম্মত হয়েছিলেন। দ্রৌপদী অবলা নন, জয়দ্রথ ও কীচককে ধাক্‌কা দিয়ে ভূমিশায়ী করেছিলেন। তিনি অসহিষ্ণু তেজস্বিনী স্পষ্টবাদিনী, তীক্ষ্ণ বাক্যে নিষ্ক্রিয় পুরুষদের উত্তেজিত করতে পারেন। তাঁর বাগ্মিতার পরিচয় অনেক স্থানে পাওয়া যায়। বনপর্ব ৫-পরিচ্ছেদে, উদ্‌যোগপর্ব ১০-পরিচ্ছেদে, এবং শান্তিপর্ব ২-পরিচ্ছেদে দ্রৌপদীর খেদ ও ভর্ৎসনার যে নাটকীয় বিবরণ আছে তা সর্ব সাহিত্যে দুর্লভ। বহু কষ্ট ভোগ ক’রে তাঁর মন তিক্ত হয়ে গেছে, মঙ্গলময় বিধাতায় তাঁর আস্থা নেই। বনপর্ব ৭-পরিচ্ছেদে তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন, ‘মহারাজ, বিধাতা প্রাণিগণকে মাতাপিতার দৃষ্টিতে দেখেন না, তিনি রুষ্ট ইতরজনের ন্যায় ব্যবহার করেন।’ দ্রৌপদী মাঝে মাঝে তাঁর পঞ্চ স্বামীকে বাক্যবাণে পীড়িত করেন, স্বামীরা তা নির্বিবাদে সয়ে যান। তাঁরা দ্রৌপদীকে সম্মান ও সমাদর করেন। বিরাটপর্বে যুধিষ্ঠির বলেছেন, ‘আমাদের এই ভার্যা প্রাণাপেক্ষা প্রিয়া, মাতার ন্যায় পালনীয়া, জ্যেষ্ঠা ভগিনীর ন্যায় রক্ষণীয়া।’ দ্রৌপদী পাঁচ স্বামীকেই ভালবাসেন, কিন্তু তাঁর ভালবাসার কিছু প্রকারভেদ দেখা যায়। যুধিষ্ঠির তাঁকে অনেক জ্বালিয়েছেন, তথাপি দ্রৌপদী তাঁর জ্যেষ্ঠ স্বামীকে ভক্তি করেন, অনুকম্পা ও কিঞ্চিৎ অবজ্ঞাও করেন, ভালমানুষ অবুঝ একগুঁয়ে গুরুজনকে লোকে যেমন ক’রে থাকে। বিপদের সময় দ্রৌপদী ভীমের উপরেই বেশী ভরসা রাখেন এবং শক্ত কাজের জন্য তাঁকেই ফরমাশ করেন, তাতে ভীম কৃতার্থ হয়ে যান। নকুল-সহদেবকে তিনি দেবরের ন্যায় স্নেহ করেন। অর্জুন তাঁর প্রথম অনুরাগের পাত্র, পরেও বোধ হয় অর্জুনের উপরেই তাঁর প্রকৃত প্রেম ছিল। মহাপ্রস্থানিকপর্বে যুধিষ্ঠির বলেছেন, ‘ধনঞ্জয়ের উপর এঁর বিশেষ পক্ষপাত ছিল।’ বিদেশে অর্জুন কিছুকাল উলূপী ও চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে কাটিয়েছিলেন, দ্রৌপদী তা গ্রাহ্য করেন নি। কিন্তু অর্জুন যখন রূপবতী সুভদ্রাকে ঘরে আনলেন তখন দ্রৌপদী অতি দুঃখে বললেন, ‘কৌন্তেয়, তুমি সুভদ্রার কাছেই যাও, পুনর্বার বন্ধন করলে পূর্বের বন্ধন শিথিল হয়ে যায়।’ দ্রৌপদীর একটি বৈশিষ্ট্য—কৃষ্ণের সহিত তাঁর স্নিগ্ধ সম্বন্ধ। তিনি কৃষ্ণের সখী এবং সুভদ্রার ন্যায় স্নেহভাগিনী, সকল সংকটে কৃষ্ণই তাঁর শরণ্য ও স্মরণীয়।

 দুর্যোধন মহাভারতের প্রতিনায়ক এবং পূর্ণ পাপী। তাঁর তুল্য রাজ্যলোভী বা প্রভুত্বলোভী ধর্মজ্ঞানহীন দুর্মুখ ক্রূর দুরাত্মা এখনও দেখা যায়, এই কারণে তাঁর চরিত্র আমাদের সুপরিচিত মনে হয়। তিনি আজীবন পাণ্ডবদের অনিষ্ট করেছেন,